সুব্রত সরকার, কলকাতা, ২১ মার্চ#
‘পুরুলিয়ার লালমাটি, রূপে–গুণে পারিমাটি ……… মঞ্চে তখন কোনও এক ঝুমুরশিল্পী বড় দরদ দিয়ে গাইছেন এ গান। একলি শুনে আপনার বুকটা আনচান করবেই। হৃদয় যদি খুব রুখা–শুখা, টুটা–ফুটা হয়, সেথায় একটা ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল ঢেউ উঠবেই। সৃজন ভূমিতে তখন যে দামামা বেড়েছে। কাড়া–আকড়া বাজিয়ে, ধামসা–মাদল দম্দমাদম আর ভেঁপুতে পোঁ তুলে ঘোষণা হচ্ছে, শুরু হল ‘সৃজন উৎসব’। তিনদিনের এক মহতী উদ্যোগ। মানুষ মানুষে মিলনের এক মহাসংগম। অপরূপ এক নৈসর্গিক পরিবেশে প্রকৃতির উদার উন্মুক্ত এক আঙিনায় এ এক যথার্থ ভারতীয়তার উৎসব – সৃজন উৎসব!
তিথিধরে প্রতিবছর তিনদিনের এই উৎসব শুরু হয় রাসপূর্ণিমা (কোজাগরি লক্ষ্মীপূর্ণিমার ঠিক পরের পূর্ণিমায়) এই মেলা ১৮ বছর পার করে এবছর রাসপূর্ণিমায় (১৭–১৯ নভেম্বর, ২০১৩) মেলা উনিশে পা ফেলবে। ‘পুরুলিয়া আদিবাসী লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র’র উদ্যোগে প্রতিবছর আয়োজন করা হয়। বাংলার এই বৃহত্তম পার্বত্যমেলা সৃজন উৎসব। এ মেলার প্রাণপুরুষ তথা উৎসব সম্পাদক সৈকত রক্ষিত।
সৃজনমেলা মূলত লোকসংস্কৃতির মেলা। লোকসংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পুরুলিয়ার ছৌ, ঝুমুর, ভাদু, করম থেকে শুরু করে আমাদের দেশজ–গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির বাউল–ফকির, পদাবলী কীর্তন, মনসা মঙ্গলের পালাগান, ভাওয়াইয়া–চটকা–জারিসারি গান, মারকতির গান, হাসন রাজার গান, লালনের গান, জীবন–উজ্জীবনের গান, আদিবাসীদের নাচ–গান–যাত্রাপালা এবং প্রতিবেশী ভিন্ রাজ্য (আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, গুজরাট, রাজস্থান) থেকে আসা হরেকরকম চোখ ঝলসানো লোকসংস্কৃতির উনুষ্ঠান তো আছেই। তাই পুরুলিয়া শহরে তখন পা ফেললেই আপনার চোখে পড়বে মেলার তোরণ। মেলার পোস্টার। সেখানে ঝলমল করছে এমন সব কথার ঝিকিমিকি, ‘আসিল সূত্র হিক্কিড় গিদিং বাজিছে মাদল! ঝমর ঝমর বাজে করতাল কিংবা কোথাও উঁকি মারছে, ‘পাহাড়ে পাহাড়ে দুন্দুভি, হৃদয়ে তার প্রতিধ্বনি! সৃজন উৎসব মানেই শৃঙ্গ বিজয়!’
এসব দেখে–পড়ে মন তো পুলকিত হবে। উড়ু উড়ু হবে তো এবার আপনি ঝপাং করে বাসস্ট্যান্ড থেকে মানবাজারগামী একটা বাসে লাফ মেরে উঠে পড়ুন দেখি। ওমা! সেখানেও গুন গুন করছে এক দুষ্ট রসিক, ‘বধুঁ, তুমার সঙে সৃজন মেলায় রঙিলা লাচ লাচিব! টুঙুল টুঙুল বাজনা বাজিবেক! টুঙুল টুঙুল বাজনা বাজিবেক। …. বাসে লাফ মেরে তো উঠলেন। ‘ছিট’ কি পেলেন? জানলার ধারে যদি বসতে পেলেন তো জয় দুগ্গা! অই শোনঅ কে আবার গুন গুন করে, ‘বাস তো ছাড়িলো, কনডাকটার উঠিলো / চলো এবার সৃজন মেলায় যাই, তুমি–আমি এক সাথেতে গাই …..
মাঠ–ঘাট–পথ–প্রান্তর, লালমাটির ধুলো উড়িয়ে বাস তো ছটছে। পথের দু’পাশে কত না নয়ানজুলি। ছোট্ট ডবা। গভীর দীঘি। সেখানে লাল শালুকের ফুল। জল ফড়িং–এর ওড়াওড়ি। আর অঘ্রাণের পাকা ফসলে ক্ষেত ভরে আছে। এসব দেখতে দেখতে এ যাত্রায় আপনার চোখ জুড়োবে। আপনি তো মেলার মানুষ। এই ফাঁকে টুকুস করে নেমে পড়ুন দেখি। ‘এ গাড়ি যাবে না, আমি অন্যগাড়ি নেব, হেই রোখও …. মনে পড়েছে এক নাগরিক কবিয়ালের এই গান। পড়ছে না? আরে সলিল কবিয়াল গো! তুমাদের সলিল চৌধুরী। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা ……’না, না রসিক, হেথায় তুমায় কেউ প্রশ্ন করার নেই, কুথা হোতে আসিছো? কেন আসিছো? কেন আসিছো? কুনও মতলব আছো নাকি গো? এখানে সবাই স্বাগত। মোস্ট ওয়েলকাম! এসো হে, বসো হে। পান–সুপারি খাও হে। দুটো নাচ–গান দেখো হে …. এ হামাদের সৃজনমেলা গো। বন্ধু, তোমাকেও চাই! ওই দ্যাখঅ আবার কানা বাউল কেমুন গাইছে, ‘হামি নাই জানি নাই জানি সখি, কথায় বৃন্দাবন গো / যেথায় দেখি বাগালছোলা সেথায় ঘুরে মন / হামার এই ত বৃন্দাবন গো, সৃজন বৃন্দাবন!’
তা বাপু, এবার তো এক অন্যগাড়িতে চড়তে হবে। চলো হে পথিক, আগে চলো। ওই শুনঅ আবার, বাতাসে গান ভাসছে, ‘চলো মন ভ্রমণে, কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে।’
এবার তুমি বান্দোয়ানগামী। কোনও একটা বাসে উঠে পড়। কাঁধের ঝোলা–ঝুলি সামলে হয়তো একটু হুটাপুটি করে উঠতি হতি পারে। মানুষে–মানুষে গা ঘষাঘষি হবে। চোখে–চোখে চাউনি হবে। ঝিলিক হবে! তা এট্টু হউক। তোমরা দুজানাই যে মেলার মানুষ। ধুলো মাখতে বেরিয়েছো।
বাস তো ছুটছে। গ্রাম, নদী, জঙ্গল, প্রান্তর পেরিয়ে ছুটছে। রাস্তার দু’পাশে সব গ্রাম। রাঙানো উঠোন। ঘরের দেওয়ালে কত চিত্রকলা। আদিবাসী গ্রাম গো সব। দু’পাশের প্রকৃতিও বড় সুন্দর। পলাশের জঙ্গল। উদার মাঠ। ধূ ধূ প্রান্তর। আকাশটাও যেন বড় বেশী নীল। একদম পলিউওশন ফ্রি! ওই শুনঅ আবারও গান, ‘পাগলের সঙ্গে যাব, পাগল হব সৃজন মেলায় …..
বাস তো এসে থামল ঘড়িদুয়ারা–কুমারীগ্রাম। নামো। নামো শিগ্গির। এই তো মোদের সৃজনভূমি। টিলা–ডুংরি–মাঠ–জঙ্গল দিয়ে ঘেরা আমাদের মেলা সৃজনমেলা। ওই তো পাতা দিয়ে বানানো তোরণ দেখা যাচ্ছে, ‘বন্ধু, এসো হে, আসিল সৃজন! হিক্কিড় গিদিং বাজিছে মাদল ….
লাজুক লাজুক পায়ে আগে ঢুলে তো পড়অ মেলায়। এবার চোখ জোড়া দাও ছড়িয়ে চারপাশে। ওই দেখো, টিলার চূড়ায় চূড়ায় মঞ্চ! ওই আমাদের শৃঙ্গবিজয়! আহা, কি সব নাম এক একটা মঞ্চের। সবার উপরে ওই দেখা যায় একদম চাঁদের কাছাকাছি যে মূল মঞ্চ তার নাম –‘কিষ্কিন্ধা শিল্পপীঠ’। একদম নীচে, টিলার পাদদেশে ধুলোমাখা ভূমিতে মুক্তমঞ্চ ‘চিত্রকূট শিল্পপীঠ’। তুমি দেখো না কত দেখবে মেলা। এ মেলা এক সব পেয়েছির মেলা। তিনমঞ্চে তিনরকম অনুষ্ঠান একই সঙ্গে হচ্ছে। তুমি যদি ছুটতে পারো, দৌড়ে দৌড়ে টিলায় উঠতে পারো, বুকে হাঁপ না ধরে, দমে যদি ঘাটতি না থাকে, ছোটও, দ্যাখঅ, হৃদয় জুড়ায়। চোখ সার্থক হবে। দিল দিওয়ানা হবে! নিজেকেই নিজে গুণ গুণ করে বলবে, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে? মন যা কর ত্বরা কর এই ভবে! …..’
তিনরাত্রির এই মেলায় প্রায় তিনলক্ষাধিক লোকের মিলনমেলা হয়ে ওঠে এই সৃজনভূমি। আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হবে আপনার। চোখকে বিশ্বাস করাতে হলে আপনাকে একবার আসতেই হবে। এ মেলা দিনে শুনশান, রাতে হাজারো গান। সারারাত ধরে চলেছে উৎসব। আসছে মানুষ। আসছে গাড়ি। মেলার একমাত্র পাহারাদার মাথার ওপরের মস্ত বড় ওই চাঁদটা। রাসপূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদ তো নয় যেন এক পাঁচকেজি চিনির গোলবাতাসা। তার জোছনা কি মিষ্টি কি মিষ্টি!! হামাগুড়ি দিয়ে যেন পিঁপড়ের মত হেঁটে যায় কত কত মানুষের ঢল সে চাঁদের দিকে। চাঁদের আলোয় ধুয়ে যায় সারা সৃজনভূমি। আলোয় যেতে যায় মানুষজনেরা। ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা ……’এ হল সেই আলো!
গ্রাম–গ্রামান্তর, মাঠ–ঘাট–প্রান্তর পেরিয়ে মানুষ ক্ষেত–ক্ষামেরে ধান ফেলে রেখে ঘরে আসা কুটুমকেও সঙ্গে নিয়ে আসে তিনদিন ধরে। কত কত শিল্পী। কত বিচিত্র নাচ–গান–বাদ্যবাজনা। হেথায় রবিঠাকুরও থাকেন! তাঁর কীর্তনাঙ্গের গান মোহিত করে দেয় হেটী–মেঠো মানুষগুলোকেও!
শবর নৃত্য, রণপা নৃত্য, পুরাতনীগান, বাইনাচ, ডাঁইড় নাচ, পাঁতা নাচ, নাচনীনাচের আসর, ভাওয়াইয়া, চটকা, পদাবলী সঙ্গীত এমন সব মন জুড়ানো নাচ–গান অপেক্ষা করে থাকে রসিকজনেদের জন্য। এছাড়াও, গুজরাটের সিদ্ধিদামাল, মণিপুরের মার্শাল আর্ট, ডিব্রুগড়ের মিশিং ডান্স।
তুমি যদি রসিক হও, সুজন হও, মন উড়ু উড়ু মানুষ হও–একবার অন্তত এসো এই সৃজনমেলায়। এ এক অপরূপ তীর্থভূমি। এই তীর্থভূমিতে স্নান কর। এ জীবন তোমার ধন্য কর। পূর্ণ কর। পুণ্য কর! …..
কিভাবে যাবেন – পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে মানবাজার। দু–আড়াই ঘন্টার পথ। তারপর বাস বদল করে বান্দোয়াঙ্গামী বাসে ঘুড়িদুয়ারা–কুমারীগ্রাম। এই দুই রাস্তাতেই বাস যোগাযোগ যথেষ্ট।
কোথায় থাকবেন – মেলার মাঠেই মাটিতে ত্রিপলের উপর ঢালাও খড়বিচালির লম্বা বিছানা। চারপাশ ঘেরা থাকে রঙিন কাপড়ের প্যান্ডেলে। একটু ধুলোমেখে গড়িয়ে নিতে হবে এই সামান্য আয়োজনে। অন্যথায় কেউ কেউ যদি নিজস্ব টেন্ট নিয়ে যান, থাকতে পারবেন টিলার মাথায় কিংবা পলাশের জঙ্গলে। আর যদি নদীর জলে চান, মেলার মাঠে খান। মাত্র দশ টাকার মিল কুপনে মেলা কমিটির হেঁশেলে সত্যিই সে এক মনোরম ভুরিভোজ।
লেখকের ঠিকানা : সুব্রত সরকার, “জীবনানন্দ” ২৫ নিবেদিতা পার্ক, ব্রহ্মপুর কলকাতা ৯৬, টেলিফোন – ২৪১০–০৭৫৮, মোবাইল – ৯৮৩১০৫১৭২২
Leave a Reply