সুকুমার হোড় রায়, কলকাতা, ২৭ সেপ্টেম্বর#
প্রতিমাসের শেষ সপ্তাহে, শেষের দিকে, যেদিনই কলকাতা পুরসভার মাসিক অধিবেশন হয়, সেদিন বিরোধীরা তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ জানিয়ে আক্রমণ শানায়। এ মাসেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
আধঘন্টার বেশি প্রবল মুষলধারে যদি বৃষী হয় তাহলে মুক্তারাম বাবু ঠনঠনিয়াতে শুধু নয়, মহাত্মা গান্ধী রোডেও বৃষ্টির জমা জল অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বিরোধী পক্ষের কয়েকজন কাউন্সিলর এই অভযোগ করলে, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, জায়গার বা স্থানাভাবে নূতন পাম্প বসাতে না পারার জন্য বৃষ্টিতে জমা জল দ্রুত সরাতে অসুবিধা হচ্ছে। তবে মহাত্মা গান্ধী রোডে জমা জল দ্রুত নিষ্কাশন কেন হয় না, এই ব্যাপারে তিনি খোঁজ খবর নেবেন।
কলকাতা পুরসভার ৫৯ নং ওয়ার্ডে ১০ বি ও ১০ জি লোকনাথ বোস গার্ডেন লেনের এই দুটি প্লটের জমি মিউটেশন হয়েছে কি না স্থানীয় কাউন্সিলর জানতে চাইলে, মেয়র জানান, এখনও পর্যন্ত হয়নি।
আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে মেয়র জানান, কলকাতা পুরসভার অধীন পার্কগুলিতে বৃক্ষরোপন করার কোনও সুযোগ বা অবকাশ না থাকলেও তারা উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ বিশারদদের সব সমীক্ষা ও পরিদর্শনের জন্য নিয়োগ করেছেন। তারাই পরামর্শ দেবে, কী ধরনের বৃক্ষ রোপন করা যেতে পারে। তাদের পরামর্শ অনুসারে বৃক্ষরোপন করা হবে।
বিরোধীরা অভিযোগ করে, পুরসভার অধীন অনেক পার্কে মালি নেই, নেই কোনও প্রহরী, নেই কোনও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। কাউন্সিলর রাজীব বিশ্বাসের অভিযোগ, ৩০ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে পুরসভার অনেকগুলি পার্ক হস্তান্তরিত হয়ে বাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ হচ্ছে, কলকাতা পুরসভা এই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। কলকাতার রাস্তার ও পার্কের কোনও গাছ কাটা যাবে না, শুধু ডাল-পালা ছাঁটা যাবে, এই আইন থাকা সত্ত্বেও, কলকাতা জুড়ে রাস্তার ধারে হোর্ডিং-ব্যানার লাগাবার জন্য গাছের ডাল কাটা হয়েছে, ২৭ নম্বর নারিকেলডাঙা মেন রোডে ১০০ বছরের পুরনো বটগাছটি কেটে নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের প্রত্যুত্তরে মেয়র পারিষদ দেবাশিষ কুমার বলেন, এই ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না। আমি আজই অভিযোগের দরুন জানতে পারলাম, আজই ওখানে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যা ব্যবস্থা নেবার নেবো। দোষীদের শাস্তি দেবো। পার্কে ও রাস্তার ধারে অবস্থিত এই গাছগুলির ডাল পুরসভার পক্ষ থেকে কাটা হয়নি, পুরসভার কর্মীরা এই কাজ করেনি, পুজো কমিটিগুলো ও স্থানীয় লোকেরা এই কাজ করেছে। ৩০ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের যে পার্ক ও খেলার মাঠগুলি এতদিন মানুষ ব্যবহার করেছে, সেই পার্ক ও মাঠের জমিগুলি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, জমির মালিকরা তাদের জমিতে মালিকানা স্বত্ত্বের দ্বারা বাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করছে। এমন কোনও আইন আছে কি, যাতে এটা আটকানো যায়?
৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শ্রীমতি দীপু দাস অভিযোগ করেন, পিকনিক গার্ডেনের ১ নম্বর বেদিয়াডাঙা মসজিদ বাড়ি লেনে চারিদিকে প্রাচীন দিয়ে ঘেরা সরকারি জমিতে অস্থায়ীভাবে ঘর তৈরি করে লোকে বসবাস করছে। এর উত্তরে মেয়র জানান, ওই জমিটি কলকাতা পুরসভা বা সরকারের নয়। দীপু দাস প্রতিবাদ করে বলেন, আমার কাছে দলিল ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র আছে, যার দ্বারা প্রমাণ করা যায়, জমিটি সরকারের।
২৫ সেপ্টেম্বর মাসিক অধিবেশনের শুরুতে পুরসভার চেয়ারম্যান সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ১০০ দিনের কাজের জন্য, কাজ যারা করেন, তাদের কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে মাথা পিছু দেড় হাজার টাকা বোনাস দেওয়া হবে ঘোষণা করেন। বিরোধীরা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে চিৎকার করে বাক বিতণ্ডা শুরু করে দেয়। তারা বলে, বোনাস না অনুদান, কোনটা দেওয়া হবে নির্দিষ্ট করে জানানো হোক। কারণ, উৎপাদনশীল শ্রমের কাজ ছাড়া বোনাস দেওয়া যায় না। অনুদানও দেওয়া যায় কি? বিরোধীদের এই প্রশ্নের উত্তরে মেয়র বলেন, এরা সবাই দুস্থ, দরিদ্র মানুষ, আপনারা বোনাস বা অনুদান যাই বলুন আমরা গতবছর এক হাজার টাকা দিয়েছি, এ বছর দেড় হাজার টাকা দেবো।
কলকাতার রাস্তাগুলি মেরামত সম্পর্কে মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ আশ্বস্ত করে বলেন, পূজার আগেই কলকাতার সব রাস্তা অ্যাসফলটাম দিয়ে সুন্দর করে মেরামত করা হবে, তার জন্য টাকার অভাব হবে না, যত টাকা ব্যায় হোক, পুরসভা সেই ব্যায়ভার বহন করবে। দেরি হবার কারণ, এতদিন বৃষ্টির জন্য এই কাজ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবাদ জানিয়ে কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায় বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ত্রিফলা বাতি থেকে নিকাশি মাটি, পুরসভা একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, এক লরি নিকাশি মাটির পরিবর্তে আট লরির টোকেন নিয়েছে। পুরসভা এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। এই কাজ দেখা ও ধরার জন্য পুরসভা যাদের মাইনে দিয়ে নিয়োগ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় না? এই ধরনের ৪৫৭৭টি ভুয়ো টোকেন দিয়ে টাকা নিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। টাকা নেওয়ার জন্য যে বিল তারা পেশ করে, তার সময় ও স্থানের মধ্যে অসঙ্গতি আছে। মেয়র বলেন, এই দুর্নীতি আমরাই প্রথম ধরি। এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত দুই ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাদের টাকা দেওয়া হয়নি। শাস্তিও দেওয়া হবে। বিরোধীরা অভিযোগ করে, শুধু ত্রিফলা বা নিকাশি মাটি নয়, ৫০ হাজার ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট কেলেঙ্কারি, পুরসভার ঘোষণা মতো কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে করিয়ে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হলো। আজ পর্যন্ত পুরসভা কলকাতায় বসবাসকারীদের মধ্যে কারা দারিদ্র্যসীমার নিচে, তার তালিকা তৈরি করতে পারল না। পুরসভা এই কাজের দায়িত্ব কেন কাউন্সিলরদের দিচ্ছে না? যদি কোনও দুর্নীতি ও স্বজন পোষণ হয়, তার জন্য তারা দায়ী থাকবে। এর উত্তরে মেয়র জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে এই তালিকা তৈরি করতে হয়, আশা করি খুব শীঘ্র এই তালিকা তৈরি হয়ে যাবে।
বিরোধীরা আরও অভিযোগ করে, মেঘা, আনন্দধারা ইত্যাদি ৮টি সমবায় সংস্থা কয়েক বছর ধরে গাড়ি রাখার জন্য পার্কিং ফি আদায় করে কলকাতা পুরসভাকে প্রাপ্য টাকা দেয়নি। মেয়র জবাব দেন, এই কয়েক কোটি টাকা অনাদায়ী রয়ে গেছে, কারণ এই আটটি সমবায় সংস্থার নাম, ঠিকানা সবকিছু ভুয়ো, তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply