নাম প্রকাশে অপারগ এক সরকারি লাইব্রেরিয়ানের মন্তব্য, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, ৩১ মার্চ
আমাদের তিন ধরনের লাইব্রেরি আছে — পাবলিক, অ্যাকাডেমিক ও স্পেশাল। অ্যাকাডেমিক ও স্পেশাল লাইব্রেরির ব্যবহার সীমাবদ্ধ; একমাত্র পাবলিক লাইব্রেরি — যা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি — সকলের ব্যবহারের জন্য। আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা বা ইউনেস্কো ম্যানিফেস্টো ফর পাবলিক লাইব্রেরিতে বারবার বলা হয়েছে, ‘অ্যাকসেস ফর অল’। কথাটা আমরা যেভাবে বুঝেছি, পাবলিক লাইব্রেরি যেখানে অবস্থিত সেখানকার সমাজের দরিদ্রতম থেকে ধনী, সকলের পাঠাগারকে সমান ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক লাইব্রেরি আইন ১৯৭৯-তেও এই নীতি সমর্থিত হয়েছে। আমরা জেনেছি, পাবলিক লাইব্রেরির পাবলিক পরিষেবার তিনটি উদ্দেশ্য — ১. সারা জীবনের জন্য ব্যবহার; ২. জীবন ও জীবিকার জন্য ব্যবহার এবং ৩. বিনোদনের জন্য ব্যবহার।
১৯৮০ সালে রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিভাগের অধীনে ডিপার্টমেন্ট অফ লাইব্রেরি সার্ভিসেস (ডিএলএস) তৈরি হয়। ১৯৮৮ সালে ডিপার্টমেন্ট অফ মাস এডুকেশন এক্সটেনসন অ্যান্ড লাইব্রেরি সার্ভিসেস তৈরি হওয়ার পর ডিএলএস-কে এই বিভাগ ও নবগঠিত ডাইরেক্টরেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮০ সালের আগে ছিল ৭৬২টি পাবলিক লাইব্রেরি, এখন রয়েছে ২৪৭৪টি। এর মধ্যে তৃণমূল স্তরে রয়েছে ১৮৮৫টি গ্রামীণ ও ৩২৮টি প্রাথমিক ইউনিট।
১৪ মার্চ ২০১২ ডিপার্টমেন্ট অফ মাস এডুকেশন এক্সটেনসন অ্যান্ড লাইব্রেরি সার্ভিসেস একটি অর্ডার ইস্যু করে। এতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে : ১. রাজ্যের কোনো পাবলিক লাইব্রেরিতে কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রকাশিত এবং/অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রকাশিত বলে মনে হচ্ছে এরকম সংবাদপত্র/দৈনিক পত্রিকা কেনার জন্য কোনো সরকারি অর্থ খরচ করা হবে না। ২. রাজ্যে পাবলিক লাইব্রেরির দ্বারা ক্রয় করা সংবাদপত্র/দৈনিক পত্রিকা এই পত্রিকাগুলির মধ্যে সীমিত থাকবে, যথা, সংবাদ প্রতিদিন, সকালবেলা, খবর ৩৬৫ দিন, একদিন, দৈনিক স্টেটসম্যান, সন্মার্গ, আখবার-ই-মশরিক এবং আজাদ হিন্দ।
২৮ মার্চ ওই বিভাগের আর একটি অর্ডারে এই তালিকায় আরও পাঁচটি সংবাদপত্র যুক্ত করা হয়, যথা, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আজকাল, হিমালয় দর্পণ এবং কলম।
আমাদের উদ্বেগের বিষয় দুটি। প্রথমত, এই অর্ডার হয়েছে সংবাদপত্রের বিষয়ে। আমাদের মনে রাখা দরকার, নথিভুক্তি অনুযায়ী সংবাদপত্র বলতে বোঝায় খবরের কাগজ থেকে শুরু করে শিশু পত্রিকা, খেলার পত্রিকা, বিজ্ঞান পত্রিকা, সাহিত্য পত্রিকা এবং যাবতীয় লিট্ল ম্যাগাজিন। রেজিস্ট্রার অফ নিউজপেপার্স ফর ইন্ডিয়া বা আরএনআই-এর নথিভুক্ত পত্রিকার সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে এখন ৭২০০। এছাড়া রয়েছে আরও কয়েক হাজার অনথিভুক্ত বাংলা লিট্ল ম্যাগাজিন। সরকার ওপর থেকে সংবাদপত্র নির্বাচন করে দেওয়ার মাধ্যমে এই বৈচিত্র্যময় বিপুল পত্রপত্রিকার জগতকে অপমান করছে। এটা কেবল গুটিকয়েক ‘সর্বাধিক বিক্রিত’ বা ‘বহুল প্রচারিত’ সংবাদপত্রের বিষয় নয়। যে পত্রিকা বহুল প্রচারিত নয়, সেই পত্রিকাটিকেও সমাদরে গ্রহণ করতে পারে কোনো পাবলিক লাইব্রেরির পাঠকসমাজ। এমনকী তা নথিভুক্ত (রেজিস্টার্ড) নাও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এই সমস্ত পত্রিকার মধ্যে কোনটি কোন পাবলিক লাইব্রেরিতে কেনা হবে, সেটা এতদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই লাইব্রেরির পাঠক/সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত স্থানীয় পরিচালন সমিতি। কারণ আমরা গ্রন্থাগারিকরা এতদিন শিখে এসেছি, এক আদর্শ পাবলিক লাইব্রেরি হল কোনো গ্রামাঞ্চল, মফঃস্বল বা শহরের স্থানীয় সমাজের বৈঠকখানা (ড্রয়িং রুম অফ দ্য কমিউনিটি)। তার কাজ হল সম্ভাব্য পাঠককে প্রকৃত পাঠকে পরিণত করার জন্য উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা। শুধু রুটিনমাফিক লাইব্রেরির তালা খুলে বসে থাকা আমাদের কাজ নয়। ডিএলএস-এর কাছে আমরা প্রতিমাসে হিসেব দিই, গড়ে কতজন পাঠক লাইব্রেরিতে পড়তে এসেছে। কিন্তু সেই পরিসংখ্যান দিয়ে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না, পাবলিক লাইব্রেরি পাঠকের পড়বার ও জানবার খিদে কতটা মিটিয়েছে। সরকার বর্তমান অর্ডারের মাধ্যমে একে নিতান্তই এক সরকারি নির্দেশমাফিক চলা লাইব্রেরিতে পরিণত করতে চায়, পাবলিক অর্থাৎ জনসমাজের অধিকারকে খর্ব করতে চায়।
১৮৩৫ সাল থেকে পাবলিক লাইব্রেরির এক দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের রয়েছে। সেই ইতিহাস আজ এক সংকটের মুখোমুখি। সরকারের এই অর্ডারের মধ্যে এক অশুভ ইঙ্গিত রয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরির চরিত্র এতে বিপন্ন হবে। বিষয়টা শুধু ১৩টা কাগজকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে নয়। যেখানে একটি বড়ো লাইব্রেরি (স্টেট বা টাউন) ১৮-২০টি সংবাদপত্র রাখে, কোনো রুরাল বা প্রাইমারি ইউনিট (লাইব্রেরি) তো মাত্র দুটি সংবাদপত্র রাখে। তাদের এই ১৩টির মধ্যে থেকেই দুটি বাছাই করে নিতে হবে। এছাড়া প্রতিটি লাইব্রেরিতে গড়ে ওঠে পত্রপত্রিকার একটি সংগ্রহশালা (আর্কাইভ)। তার মধ্যে ধরা থাকে সেই অঞ্চলের স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি। আজকের নির্দেশনামার আঘাত কি সেই অবধিও পৌঁছাবে না?
Leave a Reply