শ্রীমান চক্রবর্তী, ১৪ জুলাই, তথ্যসূত্র sandrp ওয়েবসাইট#
মধ্য হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত ‘মালেথা’ উত্তরাখণ্ডের তেহরি জেলার ৪৫০ পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধশালী গ্রাম। ৫৮ নং জাতীয় সড়কের শেষে, অলকানন্দার ডান তীরের আড়াআড়ি ৪০০ মিটার দূরত্বে কীর্তি ব্লকের মধ্যে মালেথা গ্রামের অবস্থান। দেবপ্রয়াগ থেকে এটি ২৫ কিমি ওপরে, যেখানে অলকানন্দা ও ভাগরথী মিশে গঙ্গা নদীর সৃষ্টি করেছে। অলকানন্দা নদীর আশেপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে মালেথার ৫০০ একর উর্বর কৃষি জমি। একদা নিষ্ফলা এই জমি, প্রায় সমগ্র কৃষি জমির ৭০% সেচের সুবিধা পেয়ে চলেছে সেই গত ষোড়শ শতক থেকে। শ্রী মাধব শিং ভাণ্ডারীর উদ্যোগেই কৃষির জন্য এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেই কারণেই তিনি এই অঞ্চলের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন এবং আজও এখানকার মানুষ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েই বেঁচে রয়েছে। সেচের অধীনস্থ কৃষি জমিগুলি থেকেই মালেথা গ্রামের প্রধান খাদ্যদ্রব্যগুলি সরবরাহ হয়ে থাকে। এই কারণেই উত্তরাখণ্ডের এই গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে অভিবাসন মাত্র ১% যেখানে অন্যান্য গ্রাম থেকে জীবিকার কারণে হাজার হাজার মানুষের অভিবাসন ঘটে। তাই আজও মালেথা গ্রামের মানুষ শ্রী মাধব শিং ভাণ্ডারীকে স্মরণে রেখেছেন, যিনি এই সমগ্র অঞ্চলকে সেচের আওতায় আনার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন।
অতি সম্প্রতি মালেথা গ্রামের পরিধির মধ্যেই পাঁচটি স্থানে পাথর চূর্ণকারী যন্ত্র (stone crusher) বসানো ও রেলওয়ে লাইন গ্রামের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে মালেথা গ্রামের দীর্ঘদিনের শান্তি ও স্থায়িত্বে আঘাত আসে। একই সাথে মালেথার গ্রামবাসীরাও বাইরে থেকে আমদানি করা উন্নয়ন পরিকল্পনাকে গণতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলার করার সুযোগ লাভ করে। গত প্রায় আট-ন মাস ধরে মালেথাবাসী আর কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে আমদানি করা এই উন্নয়নের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তাদের অসম্মতির কথা ধারাবাহিক অহিংস অনশন আন্দোলনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে এবং সমগ্র হিমালয়ের কোল জুড়ে বসবাসকারী জনসমাজের সুস্থায়ী জীবনযাপনের এক নয়া দৃষ্টান্তও তুলে ধরে।
পাথর খাদানের বিরুদ্ধে মালেথার আন্দোলন
মালেথার প্রগতি ও শান্তি প্রথম বিঘ্নিত হয় যখন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামের মধ্যে দুটি পাথর খাদানের যন্ত্র বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আরও তিনটি পাথর কাটার যন্ত্র বাসানোর উদ্যোগ শুরু হলে গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে এই খাদানের ফলে গ্রামের মধ্যে কী কী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। চালু দুটি পাথর খাদানের সাথে সাথে আরও তিনটি পাথর কাটার যন্ত্র বসানোর কাজ শুরু হতেই মালেথা গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ দৃশ্যতই নরকে পরিণত হয়। এই খাদানের জন্য আশু ভয়াবহ অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই মালেথাবাসী ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট মালেথা সংঘর্ষ সমিতি গঠন করে তাদের গ্রাম থেকে সমস্ত পাথর কাটার যন্ত্র সরিয়ে ফেলার দাবি জানায় স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাছে। ২০১৪ সালের ২৩ আগস্ট এই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় যখন পরিবেশবিদ অনিল পি যোশী সহ কয়েক হাজার গ্রামবাসী, যাদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা, কীর্তিনগরের এসডিএম অফিসের সামনে ধরনা প্রতিবাদ জানায়। প্রায় একমাস ধরে জেলা প্রশাসনের সাথে আন্দোলনকারীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ কোনো আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় গ্রামবাসীরা উপ-মহকুমা শাসকের অফিসের সামনে ধরনা ও ঘেরাও আন্দোলন চালাতে শুরু করে এবং স্থানীয় শাসনের ওপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি করতে থাকে যাতে চালু থাকা পাথর খাদানগুলিকে অবিলম্বে বন্ধ করা হয়। ফলে নির্মাণরত পাথর খাদানগুলি বসানোর কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তথা আন্দোলনের ৪২তম দিনে গ্রামবাসীরা তাদের লাগাতার আন্দোলনের প্রাথমিক সুফল পায় যখন উপ-মহকুমার তরফে খাদানগুলি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৪ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুমতিপ্রাপ্ত খাদানগুলিকে বন্ধ করার প্রশাসনিক নির্দেশের বিরুদ্ধে পাথর খাদানের বরাত পাওয়া কোম্পানিগুলি নৈনিতাল হাইকোর্টে মামলা করলে কোর্টের পক্ষ থেকে খাদানগুলি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়, কারণ খাদানগুলি বসানোর অনুমতি তাদের রাজ্য সরকারই দিয়েছে, এই যুক্তিতে। পাথর খাদানের প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হলে মালেথার গ্রামবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২১ ডিসেম্বর থেকে তারা লাগাতার আন্দোলনে নামে। ২০ জানুয়ারি ২০১৫-তে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠে যখন ওই গ্রামেরই একজন মহিলা শ্রীমতি সীতা দেবী খাদানগুলি বন্ধের দাবি নিয়ে আমরণ অনশনে বসে। তার অনশনের ১১তম দিনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে জবরদস্তি তুলে নিয়ে গিয়ে শ্রীনগর হাসপাতালে স্যালাইন দেওয়া হয়। এই ঘটনার খবর আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তেই খাদান বিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো সমগ্র উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই একই দিনে হিমালয় বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক সমীর রাতুরি লাগাতার অনশনে বসলে সমগ্র উপত্যকা জুড়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে মালেথার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। সাধারণ জনতার মধ্যে মালেথার ঘটনার প্রতিক্রিয়া বুঝতে পেরে রাজ্য সরকারও খাদানগুলি সম্পর্কে সরকারি সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। এবং পরিস্থিতি যাতে হাতের বাইরে চলে না যায় তাই মুখ রক্ষার জন্য সরকার চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী তদন্তের নির্দেশ দেয়।
৩ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটির সদস্যরা এলাকা পরিদর্শনে যায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মালেথা গ্রামে কোনোরকম জনসমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। ৭ফেব্রুয়ারি সমীর রাতুরির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ৭২ জন মহিলা সেদিন গ্রেপ্তার হয় যখন তারা পাথর খাদান কেন্দ্রগুলির দিকে পদযাত্রা করে এগোতে থাকে। এই ঘটনা উত্তরাখণ্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শোরগোল ফেলে দেয়। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হরিশ রায়ত পরিস্থিতির মোকাবিলায় হস্তক্ষেপ করে গ্রামবাসীদের আশস্ত করে জানান যে শীঘ্রই তিনটি জায়গা থেকে পাথর খাদানের মেশিন সরিয়ে নেওয়া হবে। চোদ্দোতম দিনে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা তাদের কাছে পৌঁছালে গ্রামবাসীরা তাদের অনশন ভঙ্গ করে উত্তরাখণ্ডের প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি কিশোর উপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের সাথে দেখা করে চতুর্থ এমনকী পরবর্তী পর্যায়ে পঞ্চম পাথর খাদান মেশিনটিকেও সরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে মালেথার গ্রামবাসীরা সকলে মিলেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় যতদিন না পঞ্চম পাথার খাদানটি বন্ধ হচ্ছে। ইতিমধ্যে নৈনিতাল হাইকোর্ট থেকে একটি খাদান মেশিন বন্ধ না করার প্রতি স্থগিতাদেশ দেয়, সরকারি সিদ্ধান্তকে নাকচ করে। বাকি চারটি ইউনিট বন্ধ হলেও কর্তৃপক্ষ তাদের মেশিনপত্র তখনও পর্যন্ত রেখে দেয়। ইতিমধ্যে হিমালয় বাঁচাও আন্দোলনের তরফে নৈনিতাল হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়, যার ভিত্তিতে কোর্ট খাদানের বরাত পাওয়া কোম্পানিগুলিকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে নির্দেশ দেয়।
কেন মালেথার গ্রামবাসীরা পাথর খাদানের বিরোধিতা করছে? এই প্রশ্নের উত্তরে মালেথার গ্রামবাসীরা জানায় যে তারা উন্নয়ন বিরোধী নয়, তবে তাদের অঞ্চলে কোনো শিল্প স্থাপন করতে হলে আগে তাদেরকে অবহিত করার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু মালেথা কৃষিতে সমৃদ্ধশালী একটি গ্রাম, এবং কাজের খোঁজে এই গ্রাম থেকে অন্যত্র অভিবাসন খুবই কম, মালেথা একটি উন্মুক্ত উপত্যকা, তাই এখানে উপত্যকার উপরের দিকে খাদানের মেশিনগুলি বসানোয় এর ধূলিকণা সহ দূষণ সমগ্র অঞ্চলের কৃষি জমির ওপর পড়বে এবং কৃষির ক্ষতির সাথে সাথে সমগ্র বনভূমি, তৃণভূমিকেও দূষিত করবে। কৃষির ক্ষতি হলে এই অঞ্চলের স্বয়ংসম্পূর্ণতাও বিনষ্ট হবে। তাছাড়া পাথর কাটার মেশিনগুলির চালনা শব্দ দূষণের সাথে সাথে পাথরের ধূলো-বালি শুধু মানুষের স্থাস্থ্যকেই নয়, গবাদি পশু ও তাদের খাদ্যসামগ্রীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়া মালেথার গ্রামবাসীরা জানায় যে একটি জেলায় সর্বাপেক্ষা দশটি পাথর খাদানের ইউনিট থাকতে পারে যার মধ্যে ইতিমধ্যেই কীর্তিনগর ব্লকে ৮টি রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি মালেথাতেই। গ্রামবাসীরা সরকারি নীতির সমালোচনা করে জানায় যে ভালো হয় যদি সরকারের তরফে মালেথায় পাথর খাদান মেশিন বসানোর চেয়ে, কৃষিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়।
এমনকী গ্রামবাসীরা এই প্রশ্নও তোলে, সরকারের এমন কোন প্রয়োজন পড়ল যে এক সাথে মালেথায় পাঁচটি পাথর খাদান ইউনিট গড়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, যেখানে সকলেই জানে যে ঐতিহাসিকভাবেই মালেথা কৃষিতে সমৃদ্ধশালী গ্রাম আর এই কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মহিলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মালেথার আন্দোলনে মহিলারা প্রথম থেকেই ছিল অতি সক্রিয়। চিপকো আন্দোলন খ্যাতি পেয়েছিল গোরা দেবীর ন্যায় মহিলার সক্রিয় ভূমিকায়। আর আজকের উত্তরাখণ্ডে সীতা দেবী ছাড়াও রয়েছে শতশত গোরা দেবী যাদের মধ্যে আছেন বিমলা দেবী, অনিতা রানা, সুশীলা দেবী, অনিতা মাহর, রুকমনি দেবী, দেবেশ্বরী, নৌরতি দেবী, লক্ষী দেবী বিজয় লক্ষী প্রমুখ। এই আন্দোলনে থেকেই মালেথার গ্রামবাসী উন্নয়নের এক নয়া মডেল নির্মাণের জন্য একটি কনভেনশন সহ ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছে যেখানে উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবেশবিদ, অধ্যাপক, সমাজকর্মী, ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দলের কর্মী সহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হন। মালেথার আন্দোলনের মধ্য থেকেই উত্তরাখণ্ড সহ সমগ্র হিমালয়ের অংশ জুড়েই উন্নয়ন নিয়ে নতুনভাবে ভাবার কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত ১২৮ কিমি দীর্ঘ ঋষিকেশ-কর্ণপ্রয়াগ রেল যোগাযোগের যে প্রস্তাব করা হয়েছে মালেথার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই পরিকল্পনারও বিরোধিতা করা হয়। কারণ এই প্রস্তাবিত রেলপথের জন্য পাহাড় ফাটিয়ে ৮১টি টানেল তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে হিমালয়ের ওপর আরেকটা আঘাত। তাই মালেথার এই সফল আন্দোলন আগামী দিনে পরিবেশ ধ্বংস করার বিরুদ্ধে, সুস্থায়ী জীবন-জীবিকা রক্ষার্থে নতুন পথ দেখাবে বলেই সকলে মনে করছে।
Leave a Reply