শ্রীমান চক্রবর্তী, পাতিপুকুর, ৩১ জুলাই#
লেক টাউন পাতিপুকুর ১নং পল্লিশ্রী কলোনির প্রায় তিন বিঘা আয়তনের বৃহদায়তন জলাশয়টির কথা জানা গেল স্থানীয়দের স্মৃতিচারণে। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতার আসার আগে এই অঞ্চলের অবস্থা ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জলাশয় আর খানাখন্দের মাঝে মাঝে গজিয়ে ওঠা দরমার বেড়া আর টিনের ছাউনি দেওয়া এক উদ্বাস্তু কলোনি। এই অঞ্চলের স্থানীয়দের বসতি ও পাতিপুকুর উদ্বাস্তু কলোনির আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু ছোটো মাঝারি ধরনের শিল্প কারখানাও। ব্রঙ্কল ওষুধের কারখানা ছিল একেবারে জলাশয়ের পশ্চিম পাড়ে। পাতিপুকুর অঞ্চলের ভিআইপি রোড আর যশোর রোডের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী এস কে দেব রোডের নতুন পল্লির অংশে ডান দিকে ১নং পল্লিশ্রী কলোনির পূর্ব-পশ্চিম বরাবর আড়াআড়ি আয়তাকার প্রায় তিন বিঘা আয়তনের জলাশয়টি এখন একটি জঞ্জালের আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের প্রতিদিনের ফেলা জঞ্জাল আর প্রোমোটারদের ফেলা পুরোনো বাড়ির রাবিশে এই অঞ্চলে একদা ব্যস্ততম ও অতি প্রয়োজনীয় জলাশয়টি এখন এক পরিকল্পিত ভাগাড়।
বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে স্থানীয়দের জলাশয়কে অপব্যবহার আর এলাকার সাধারণের উদাসীনতায় অতীতের এই ব্যস্ততম জলাশয়টি এখন এক পরিকল্পিত খাটালে পরিণত হয়েছে। ভরা বর্ষায় মাঝে মধ্যেই জলমগ্ন এই জনঘন সন্নিবিষ্ট ১নং পল্লিশ্রী কলোনি নতুনপল্লির শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কাছেই সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা এখন এক চ্যালেঞ্জ। একদা জলাশয়ের তিন দিকে ছিল বাঁশ আর গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো কাঁচা ঘাট। তাতে বসেই কলোনিবাসীসহ স্থানীয়রা প্রতিদিনের ধোয়া-মাজা-কাচা-স্নানের কাজ করত। এমনকী গবাদি পশু স্নান করানোও হত এই জলাশয়টিতে। চার দশক আগে এই জলাশয়টির আশেপাশে ছিল বেশ কয়েক ঘর রজক শ্রেণীর বাস। তারা পুকুরের ওপর বাঁশের সাঁকো বানিয়ে তক্তা পেতে কাপড় আছাড় মারতেন। অর্থাৎ একদা এই জলাশয়টি স্থানীয়দের দৈনন্দিন জলের ব্যবহারিক চাহিদাই মেটায়নি, সাথে সাথে বেশ কয়েকটি পরিবারের জীবিকাও নির্ভরশীল ছিল।
এক স্থানীয় বাসিন্দার কথায় ৬০-এর দশকের শেষের দিক থেকেই জলাশয়ের আশপাশের বসবাসকারী কিছু উদ্বাস্তু পরিবারগুলির বদান্যতায় জলাশয়টির ওপর দূষণ প্রক্রিয়া শুরু হয় যখন তাদের পয়ঃপ্রণালীর নিকাশি ব্যবস্থা জলাশয়ে ফেলা হতে থাকে। এর পর থেকেই জলাশয়টি ধীরে ধীরে ব্যবহারের অযোগ্য হতে শুরু করে। অবশ্য এই অঞ্চলে প্রথমে গভীর নলকূপ, এবং দক্ষিণ দমদম পৌরসভার উদ্যোগে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহ ব্যবস্থা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হলে এলাকার মানুষের জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে শুরু করে। এর সাথে সাথে চলতে থাকে জলাশয়ের প্রতি অবহেলা ও দূষণের কাজ। পাশাপাশি জলাশয়ের ধারে বসবাসকারী পরিবারগুলির কেউ কেউ জলাশয়ের জমি ধীরে ধীরে ভরাট করে নিজ নিজ বাড়ির পরিসীমা বাড়িয়ে নেয়। এমনকী কেউ কেউ জলাশয়ের জমি ভরাট করে স্থায়ী নির্মাণও করে ফেলেছে (সেফটি ট্যাঙ্ক মূলত)। এলাকার উদ্বাস্তু পরিবারগুলি নব্বইয়ের দশকে নিঃশর্ত দলিল পাওয়ার পর পুকুরের ওপর দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল পৌঁছোনোর প্রক্রিয়ার সম্পন্ন হবার সাথে সাথেই গত দশকের থেকে শুরু জমি প্রোমোটিংয়ের ধূম। এর দৌলতে অনেকেই বেআইনি ভাবে পুকুরের জমিকে ব্যবহার করে পুরসভার অনুমতি লাভের জন্য। এলাকার কেউ কেউ দাবি জানাচ্ছে পুকুরের পাশের বসবাসকারীদের বাড়ির পুরোনো দলিলের মাপ অনুযায়ী তাদের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করা দরকার। সেই অনুযায়ী যারা জলাশয়ের জমি বেআইনি দখল করেছে তাদের থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা প্রয়োজন। যদি আইনি মতে পুকুরের প্রকৃত সীমানা উদ্ধারে প্রয়োজনে বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলার পক্ষেও কেউ কেউ বলেছে।
এখন এলাকাবাসীর তরফে কেউ কেউ বলছে, অবিলম্বে এই জলাশয়ের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা এই ভাগাড়ে পরিণত হওয়া জলাশয়টি এখন এই এলাকার আশে পাশে গজিয়ে ওঠা বহুতলের একমাত্র ভরসা, আগুন লাগলে এটিই হতে পারে তাদের রক্ষাকর্তা।
এলাকাবাসীর তরফে অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই এই জলাশয়টিকে উপযুক্তভাবে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও স্থানীয় প্রশাসন ও এই কলোনির জনপ্রতিনিধি তাকে গুরুত্ব দেয়নি। তাই এলাকার মানুষ নতুন ভাবে আশায় বুক বেঁধেছে যে নব নির্বাচিত পৌরপিতা অবশ্যই এই সমস্যার সুরাহা করবেন। আরও শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি এই জলাশয়টি সংস্কারের জন্য ৩৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হলেও তা নাকি অন্য খাতে খরচ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর আমাদের সংবাদপত্রে এই জলাশয়টিকে নিয়ে খবর করা হয়েছিল। আবার এলাকার মানুষের দাবিকে মাথায় রেখেই আমরা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
Leave a Reply