মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন ও শমীক সরকার, পাঁচামি, ৯ মে#
পাথর ব্যবসায়ী হলেও মনটিকে পাথর হতে দিইনি — এমন অহঙ্কার ছিল পাথর ব্যবসায়ীদের। সেই অহঙ্কারের মুখে জমাট বাঁধছে পাথর।
বীরভূম আর ঝাড়খণ্ড এলাকার রুক্ষ লালমাটির নিচে লুকনো আছে হরেক রকম খনিজ পদার্থ। খনিজ পদার্থের অন্যতম চায়না ক্লে বা চিনামাটি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিনামাটি উৎপাদন হলেও পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। বীরভূমের প্যাটেলনগরে ‘প্যাটেলনগর হাউস’ প্রথম চায়না ক্লে উৎপাদন শুরু করে ১৯৫৬ সালের দিকে। প্যাটেলনগর হাউসের কর্নধার স্বপনকান্তি ঘোষ। এ ব্যবসাটি শুরু করে তার বাবা নিতাইপদ ঘোষ। এই দশকের শেষের দিকে পাথর শিল্পে প্রবেশ করে ব্ল্যাক স্টোন, চিপস আর গ্রানাইটের ব্যবসা।
পাথর শিল্প প্রথম শুরু করে প্রথম বাঙালি নাজির হোসেন মল্লিক। এখন তার বয়স ৭৭ বছর। বীরভূম জেলা পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার থানা এলাকার ভাড়কাটা গ্রামে বংশানুক্রমে বাস। বীরভূম ও ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এলাকার প্রথম বাঙালি পাথর খাদান মালিক। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, ১৯৬০ সালের আগে এই এলাকায় কোনও পাথর খাদান ছিল না। ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ে বেশিরভাগ সিন্ধি, কিছু সংখ্যক পাঞ্জাবি ও মাড়োয়ারি পাথর খাদানের ব্যবসা চালাতেন।
বীরভূমে এখন শতাধিক খাদান আর সহস্রাধিক স্টোন ক্রাশার বা ‘পাথর ভাঙা কল’ চলছে। শ্রমিক মূলত আশেপাশের জেলা, বিশেষত মুর্শিদাবাদ থেকে। এখন আসছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এর ফলে শ্রমিক সংখ্যা কমলেও উৎপাদন বেড়েছে। শ্রমিকদের মধ্যেও ক্ষোভ বেড়েছে, কাজ কমার জন্য। খাদানের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও হেলাফেলা বাড়ছে। মজুরি, এক রোজ আশি টাকা।
মহম্মদবাজার থানার প্যাটেলনগর, পাঁচামি, হাবড়ি, তালবাঁধ, কাপাসডাঙা, চাঁদপাড়া, সাগরবান্ধী, আলিনগর, ভাড়কাটা, গদরবাথান, দেওয়ানগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে পাথর খাদান ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। এই পাথর খাদান এবং ক্রাশারের মালিকদের বেশির ভাগই মুসলিম, এলাকার জনবিন্যাসও সেরকম। শ্রমিকদের মধ্যেও বেশির ভাগই মুসলিম।
মল্লারপুর থেকে সিউড়ির দিকের বাসে সোঁতসাল থেকে ডানদিকে ঘুরে গেলে পাঁচামির দিকে যাওয়া যায়। বাসে পাশে বসা সহযাত্রীর খেদোক্তি শুনেছিলাম, খাদান চালু থাকলে এইসব জায়গা গমগম করে। এখন শুনশান। আলিনগর গ্রামে হিন্দু বাড়ি মুসলমান বাড়ি পাশাপাশি। একেকটা বাড়িতে, বা বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠে একাধিক ডাম্পার, স্টোন চিপস বহনে সক্ষম বড়ো ম্যাটাডোর। আমরা একাধিক বাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু কথা বলতে পারি কিনা এই খাদান নিয়ে সংঘর্ষের বিষয়ে, প্রতিটি বাড়ি থেকেই মহিলা মারফত জবাব এল, আমরা এখানে ছিলাম না, কিছু জানি না। তারপর দরজা থেকে সরে আসতেই দরাম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অবশেষে একজন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেন। বুড়ো মানুষ আর তাঁর ছেলের বউ মিলে। কিন্তু শর্ত, নাম প্রকাশ করা যাবে না।
ঘটনার সূত্রপাত অনেকদিন থেকেই। ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখে তালবাঁধি গ্রামে এক খাদানে ব্লাস্টিং-এর সময় পাথরের টুকরো লাগে আদিবাসীদের গায়ে। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ এবং এলাকায় আদিবাসী মেয়েদের গায়ে হাত তোলা থেকে মদের কারবারের বাড়বাড়ন্ত, এ সবের জন্যই এই পাথর ব্যবসা দায়ী, এ অভিযোগ আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ঘটনায়। আদিবাসীরা বিরোধ করে।
এই বিরোধের মধ্যেই এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ সোমবার বসিরুল শেখ নামে এক পাথর খাদানের কর্তা বারোমেশিয়া গ্রামে আদিবাসীদের হাতে খুন হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে এবং পাথর খাদান শিল্প চালু রাখার স্বার্থে ২২ এপ্রিল সোঁতসাল, আলিনগর, কাপাসডাঙা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে একটি মিছিল সংগঠিত করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিল পাথর খাদান ও ক্রাশার মালিকরা। এই মিছিল থেকে কিছু লোক গিয়ে সাগরবাঁধি এবং নতুনপাড়া, দুটোই মাঝি (আদিবাসী সাঁওতাল) পাড়া, সেখানে গিয়ে আদিবাসী বাড়িগুলিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। বাড়ি পোড়ানো হয়, লুঠপাঠ করা হয়। সাগরবাঁধি গ্রামে মতিলাল মাণ্ডি নামে বছর চল্লিশের একজনকে মেরে ফেলা হয়।
এর প্রতিরোধে নেমে আদিবাসীরা বেশ কিছু ক্রাশার এবং পাথর বওয়ার ডাম্পারে আগুন লাগিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে খাদান ও ক্রাশারগুলো। তারপর থেকে এলাকার খাদান শ্রমিকরা ফিরে গেছে যে যার দেশে। পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয়রা ঘরে থাকছে না, পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি রাতে তাদের বাড়ির লোকরাও বাড়ির বাইরে থাকছে। রাতে নাকি পুলিশ হানা দিচ্ছে ঘরে। শোনা যাচ্ছে, পুলিশ নাকি একটা তালিকা তৈরি করেছে, কারা কারা সেদিনের মিছিলে ছিল, তার। আর মাঝিরাও নাকি তীর ধনুক জড়ো করে রেখেছে। ভয় সেদিক থেকেও।
এখানে কি কেবল পাথর শিল্পই সম্বল? অনেকটাই। এখানে ক্যানেল নেই। তাই জমিতে একবার ধানটা হয়। তাই আদিবাসী এলাকার বাইরের মানুষ, মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে এই পাথর শিল্পের ওপর দিনে দিনে অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
যাওয়ার পথে দেখা হয়েছিল আলিনগরের মনিরুদ্দিন শেখ এর সঙ্গে, বয়স ২৫-২৬। তার কথাটা কানে গেঁথে গিয়েছিল, ‘আদিবাসীদের কথা কিন্তু ন্যায্য। আমি রামপুরহাট কলেজে পড়ার সময় আমাদের সঙ্গে পাঁচামির আদিবাসী মেয়েরা পড়ত। তারা ভয়ে নিজেদের গ্রামে যেতে পারত না।’
Leave a Reply