সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৩ মার্চ#
৯ মার্চ ২০১৩ একটি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সমন্বয়ে তৈরি প্রতিনিধিদল ওড়িশার প্রস্তাবিত পস্কো ইস্পাত প্রকল্পের গ্রাম, জগৎসিংহপুর জেলার ঢিনকিয়া এবং গোবিন্দপুর যান। ২ মার্চ সেখানে বোমার আঘাতে পস্কো প্রতিরোধ আন্দোলনের তিন কর্মী মারা যান এবং একজন গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। এই বোমা বিস্ফোরণের কিছু পরেই নতুন করে ফের জমি অধিগ্রহণের সূচনা করে ওড়িশা সরকার। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যায়ে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই জমি অধিগ্রহণের বিরোধীতা করে আসা গ্রামবাসীদের সাথে প্রশাসন এবং পস্কো প্রকল্পের সমর্থকদের সংঘর্ষ হচ্ছিল। এর আগে আন্দোলনের মাধ্যমে বারবার এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা সম্ভব হয়েছিল।
২ মার্চের বোমার আঘাতের ঘটনা বর্ণনা করে পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি এবং মৃতদের পরিবারবর্গ। নবীন মণ্ডল (৩০), নরহরি সাহু (৫২), মানস জেনা (৩২), ও লক্ষ্মণ প্রামাণিক (৪৬) পাশের পাটানা গ্রামের পানের বরজের থেকে বেরিয়ে এসে আড্ডা মারছিল, রোজকারের মতো। সেখানে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ হয় এবং প্রথম তিনজন মারা যায় ও চতুর্থ ব্যক্তি মারাত্মকভাবে ঘায়েল হয়। ওদের সঙ্গে রমেশ রাউত নামে আরেক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি কিছুক্ষণ আগে ওখান থেকে পান আনতে বেরিয়ে যান। এই ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে জগৎসিংহপুরের এসপি সত্যব্রত ভোই স্থানিয় ও জাতীয় মিডিয়াতে ঘোষণা করে, এরা নিজেরা বোমা বাঁধতে গিয়ে ফেটে মারা গেছে। তখনও পুলিহ কোনও প্রাথমিক তদন্তেও অকুস্থলে আসেনি। মারাত্মক ঘায়েল হওয়া লক্ষ্মণ প্রামাণিক হাসপাতালে জানান, তাদের দিকে বোমা ছোঁড়া হয়েছিল, পুলিশ মিথ্যে কথা বলছে। ঘটনার ১৫ ঘন্টা পরে পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছয়। অথচ কয়েক মিনিটের দূরত্বে পুলিশের দুটি প্লেটুন রয়েছে সেখানে। এবং ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পৌঁছনোর আগেই ৩ মার্চ সকালবেলা থেকে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। মৃত দুইজনের বাড়ির লোকেরা জানায়, পুলিশ ৩ মার্চ মধ্যরাতে তাদের বাড়ি এসে একটি কাগজ দিয়ে বলে সই করে দিতে। ওই কাগজে লেখা ছিল, মৃতরা নিজেরা বোমা বাঁধতে গিয়ে মারা গেছে। যখন নরহরি সাহু-র ছেলের বৌ কুসুমবতি সাহু ৩ মার্চ সন্ধ্যেবেলা স্থানীয় অভয়চন্দ্রপুর থানায় এফআইআর করতে যায়, তখন তাকে ফিরিয়ে দেয় থানা, বলে যে, নিজেরা বোম বাঁধতে গিয়ে মারা গিয়ে শেষে নিজেরাই এফআইআর করতে এসেছে। এই বিষয়ে প্রথম যে এফআইআর-টি রুজু হয় অভয়চন্দ্রপুর থানায়, সেটি করা হয় ৪ মার্চ সকালে। সেটি করেন রঞ্জন বর্ধন, এবং তা করা হয় তিনজন মৃত, আহত, অভয় সাহু, সুরেন্দ্র দাস পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতির আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে।
প্রতিনিধিদলটির পর্যবেক্ষণ, ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জের মধ্য দিয়ে এই পর্যায়ের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর, এবং বিশেষত ২ মার্চ-এর বোমা বিস্ফোরণের পর এলাকায় সংঘর্ষের ও হিংসার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। এই জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গোবিন্দপুর গ্রামের অন্তত ১০৫টি পানের বরজ ধ্বংস করা হয়েছে। ৭ মার্চ প্রকল্পবিরোধীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জে ৪১ জন গ্রামবাসী আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা। ভূমিহীন ক্ষেতমজুররা পানের বরজগুলির রোজগারের ওপরই বেঁচে থাকে। ওই এক একর জমির ওপর যে পানের বরজগুলি আছে, তার ওপর নির্ভরশীল ১৫০টি পরিবার। এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিহীনদের ক্ষতিপূরণের কোনও বন্দোবস্ত নেই।
প্রতিনিধিদল বোমা বিস্ফোরণের উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে। তাছাড়া গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে পুলিশ ক্যাম্প তুলে নেওয়া, ঢিনকিয়া পঞ্চায়েত এলাকা থেকে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ করা, এবং হত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মেহের ইঞ্জিনিয়ার, সুমিত চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন মহান্তি, প্রমোদিনী প্রধান, সরোজ মহান্তি প্রমুখ।
Leave a Reply