কুশল বসু, কলকাতা, ১৪ অক্টোবর#
আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই লাগোয়া পশ্চিম পাকিস্তানে শান্তি চলে গেছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান আগ্রাসন শুরু হতেই আফগানিস্তানের উপজাতি এলাকা থেকে তালিবানরা লাগোয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশগুলিতে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। ২০০২ সালে পাকিস্তান সরকার এদের ওপর আক্রমণ চালাতে সেনা নামিয়ে দেয়। ২০০৪ সাল থেকে ইঙ্গ-মার্কিন মিত্র পাকিস্তান সরকার পুরোদস্তুর যুদ্ধে নেমে যায়। জনসমর্থন পেয়ে যায় সশস্ত্র মার্কিনবিরোধী শক্তিগুলি। সেখানকার বেশ কিছু সংগঠন মিলেমিশে ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলে পাকিস্তানের তালিবান শক্তি তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান, শরিয়তি আইন জারি এবং ইঙ্গ মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের ডাক দিয়ে। তাদের মূল কাজ গড়ে ওঠে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং তারও পশ্চিমের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে। উল্লেখ্য, এই খাইবার পাখতুনখাওয়া ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
অস্ত্র এবং প্রচ্ছন্ন জনসমর্থনের জোরে পাকিস্তানি তালিবানরা পশ্চিম পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে ওঠে অচিরেই। কিন্তু একইসাথে তাদের কার্যকলাপে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। একের পর এক স্কুল ধ্বংস করে দেয় তারা। স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়। তালিবানদের দমন করতে সরাসরি নেমে পড়ে আমেরিকা। আফগানিস্তান যুদ্ধ বিস্তার লাভ করে পাকিস্তানেও।
এই পরিস্থিতিতে পাখতুনখাওয়ার শান্তিকামী মানুষেরা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যুদ্ধ এবং তালিবানদের জারি করা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনের এক অন্যতম নেতা, কবি এবং সোয়াত উপত্যকার একটি স্কুলের মালিক জিয়াউদ্দিনকে ব্রিটেনের বিবিসি সংবাদসংস্থা বলে, তার স্কুলের কোনো শিক্ষিকা তালিবান জমানায় পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে কিছু লিখতে আগ্রহী কি না। জিয়াউদ্দিন জানায়, তার মেয়ে লিখতে পারে, তার বয়স এগারো, নাম মালালা ইউসাফজাই। ততদিনে ওই এলাকায় মার্কিন সরকার মনুষ্যবিহীন বিমান ‘দ্রোণ’ দিয়ে আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসি-তে ‘গুল মকাই’ ছদ্মনামে মালালা-র কলাম বেরোতে শুরু করে। পাখতুনখাওয়ার সোয়াত উপত্যকার স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তালিবান-পাকিস্তানি সেনার লড়াই-ই ছিল তার মূল উপজীব্য। আগ্রাসী মার্কিন বাহিনীর এক রাষ্ট্রদূত রিচার্ড হলব্রুকের সাথে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে মোলাকাত হয় মালালা-র। মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানায়। পাকিস্তানি টিভিতে নিয়মিত আসতে শুরু করে মালালা, তালিবান শক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের মেয়েদের শিক্ষার অধিকারের দাবি নিয়ে। ইউনিসেফ পরিচালিত একটি শিশু শিক্ষা বিষয়ক এনজিও-র এক গুরুত্বপূর্ণ পদে সে আসীন হয়। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে মালালা-কে একটি পুরস্কার দেওয়া হয়, যার নাম আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার’। এই ঘটনা তাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত করে তোলে। পাকিস্তানেও সরকারের তরফে সে পুরষ্কার পায়। পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা মালালা পাক ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন ও তার মিত্র পাক সরকারের পক্ষ নিয়েছে, এমনই বার্তা চলে যায় বৃহত্তর পাক জনমানসে।
২০১২ সালে তালিবান নেতারা তাকে হত্যার হুমকি দেয়। মালালা তার ফেসবুক পাতায় লেখে, আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলব, তোমরা যা করছ, তা ভুল। ৯ অক্টোবর এক বন্দুকধারী এক ঝাঁক স্কুল পোশাকের মেয়েদের মধ্যে থেকে ‘কে মালালা’ জিজ্ঞেস করে এবং এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে তিনজন মেয়েকে আহত করে। মাথায় বুলেট লেগে অচৈতন্য হয়ে পড়ে মালালা। আপাতত বেঁচে গেছে সে। কিন্তু তার বাবা ও তাকে ফের মেরে ফেলার চেষ্টা করা হবে, জানিয়েছে পাকিস্তানি তালিবান সংগঠনের মুখপাত্র। বাবা জানিয়েছে, আমরা পাকিস্তান ছাড়ছি না, সে মেয়ে বাঁচুক আর মরুক। আমরা আদর্শবাদী, শান্তিকামী। তালিবানরা দেশের সমস্ত স্বাধীন কন্ঠকে রুদ্ধ করে দিতে পারবে না।
উল্লেখ্য, এই সপ্তাহেই ১২ অক্টোবর পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে মার্কিন ‘দ্রোণ’ হামলায় ১৮ জন মারা গেছে এবং ১৫ জন আহত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থার শিরোনাম হয়নি। কিন্তু মালালা-র ওপর হামলার ঘটনা মার্কিন-ব্রিটিশ মিডিয়ার শিরোনামে রয়েছে প্রায় এক সপ্তাহের ওপর ধরে।
Leave a Reply