কামরুজ্জামান, মেচেদা, ১৩ ডিসেম্বর#
১৯৭৮ সালে বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রথম নির্বাচনে জিতে শকুন্তলা মণ্ডল প্রথম মহিলা প্রধান হয়েছিলেন। শকুন্তলা মণ্ডলের জন্ম কলকাতার মেটিয়াবুরুজে ১৯৩৫ সালে। শৈশবে পিতামাতা বিয়োগান্তে শকুন্তলা লালিত পালিত হন তার দিদিমার কাছে। তিনি প্রথম থেকেই এক প্রতিবাদী চরিত্রের মহিলা ছিলেন। তদানীন্তন মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ২, বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট ব্লকের গোপালনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচন হন শকুন্তলা। তখন অমৃতবাজার পত্রিকায় শকুন্তলা মণ্ডলকে মিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
পেটে খাবার নেই, পড়নে বস্ত্র নেই, থাকার মতো ঘরও নেই, তবুও সততা ও সাহসীকতাকে সম্বল করে তিনি ঢুকে পড়লেন রাজনৈতিক আঙিনায়। এবং স্থান করে নিলেন বাংলার পঞ্চায়েতি ইতিহাসে। বামপন্থী আন্দোলনের একটি মাইলস্টোন হয়ে রইলেন। গত ২ জুলাই ২০১৪ তারিখে রাত্রি আটটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শকুন্তলা মণ্ডল স্মৃতি রক্ষা কমিটির পক্ষে ১৯ অক্টোবর ২০১৪ আনন্দম বৃদ্ধাবাস, রাইন, কোলাঘাটে তাঁর স্মরণ সভা আয়োজিত করা হয়। স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে ভীমচরণ মণ্ডল, তাপস রাজ পণ্ডিত, দুলাল চন্দ্র গুছাইত, গোপাল পাত্র, সুব্রত পাল, আঙুরবালা মণ্ডল, অরুণ সরকার এবং শহীদ আলি খান সবাই শকুন্তলা মণ্ডলের কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করেন।
তিনি প্রধান হওয়ার পর ১৯৭৮ সালের বন্যায় সবকিছু হারিয়ে ছিল গোপালনগরবাসী। তখন তিনি বিডিওর কাছে দরবার করে কীভাবে অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্ন বস্ত্র এবং পানীয়জল নিয়ে — বিশেষ আলোচনা হয় তাই নিয়ে। শুধু তাই নয়, বিশেষ করে গ্রামের দুস্থ প্রসূতি মা ও সন্তানরা যাতে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা পেতে পারে, সে ব্যাপারে তার সক্রিয় প্রচেষ্টা দেখার মতো। কর্মক্ষম জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্য সচেতনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বামপন্থী রাজনীতিতে যারা তার সহকর্মী প্রত্যেকেই শকুন্তলা মণ্ডলের দৃঢ়তা সততা এবং সমাজসেবার কর্মকাণ্ড গভীরভাবে তাদের নাড়া দিয়েছে বলে স্বীকার করেন।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন যে, নিজে এত মানুষের উপকার করার পর শেষ জীবনে তিনি অত্যন্ত দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন। একদিন সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে বার্ধক্যভাতার জন্য তিনি গোপালনগর অঞ্চল পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ভিড় দেখে শকুন্তলা মণ্ডল অঞ্চলের দাওয়ায় বসে পড়েন। ১৯৭৮ সালে তখনকার অঞ্চল প্রধানকে কে চেনে? এই ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি একজন সচিবের। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন অঞ্চলের, বিরোধী দল করতেন। কিন্তু প্রাক্তন প্রথম মহিলা প্রধানকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখে তিনি লজ্জিত এবং অবাক হন, তাড়াতাড়ি সসম্মানে প্রাক্তন প্রধানকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বর্তমান প্রধানের ঘরে বসান ও বার্ধক্য ভাতার সমস্ত কাগজপত্র তিনি দ্রুত তৈরি করে দেন শকুন্তলা দেবীকে। এমনই ছিলেন শকুন্তলা দেবী। নিজের জন্য কোনোদিন কারোর কাছে তিনি হাত পাতেননি বা তদ্বির করেননি। যা যা করেছেন, সবই অন্যের জন্য।
শহীদ আলি খান বলেন, বার্ধক্য বয়সে শকুন্তলাদিকে কোনোকিছু দিতে গেলে তিনি তা গ্রহণ না করে বলতেন, আমার থেকে অনেক দরিদ্র ও অসহায় মানুষ আছে। তাদেরকে দিয়ে দাও। এমনই তার মানুষপ্রেম ছিল। আটপৌরে বাঙালি মহিলা তার জনদরদী কাজকর্ম করার তাগিদ রাজনীতিতে এসেছেন — এরকম আর দেখতে পাবো কি না জানিনা।
Leave a Reply