রিখিয়া রায়, কলকাতা#
এক একটা ক্লাসে গড়ে ৪৫ জন বাচ্চা। তাদের বয়স ৫-৬ বছর। তারা প্রত্যেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, অথচ হাতে সময় মাত্র আধঘন্টা, তাই গম্ভীরভাবে বলি — ‘ইস্কুলটা গল্প করার জায়গা নয়, কেউ কথা বলবে না, কারোর কোনো প্রশ্ন থাকলে হাত তোলো’। কেউ অবাধ্য হলেই দিতে হয় প্রচণ্ড ধমক, দেখাতে হয় ভয়, নইলে পাশের ক্লাসের অসুবিধা হবে তো!
টিচার্স ট্রেনিংয়ে যা যা শেখানো হয়েছে সব ভুলে যেতে জোর করা হয়েছে নতুন পড়াতে আসা শিক্ষকদের। ক্লাস ম্যানেজ করা শেখানোর নাম করে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখে নীরস কিছু তথ্য গড়গড় করে বলে যেতে হয়। ক্লাসটা আনন্দদায়ক না হলেও চলবে, ম্যানেজ করতে শেখো, ট্রেনিংয়ে যা শিখেছ ওসব বাস্তবে সম্ভব নয় — একথা বলেছেন ইস্কুলের হেড দিদিমণি, আমাকে যেচে ডেকে। কলকাতার বুকে এই নামি ইস্কুলটিতে সরকারি প্রশিক্ষণকে মানা হয় না। বরং প্রশিক্ষণে ঠিক যা শেখানো হয় তার বিপরীত কাজ অভ্যাস করা হয়।
বছর পঁয়ত্রিশের বনানীদি ক্লাস নিতে নিতে মনে মনে ভাবেন, তাঁর সন্তানকেও স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার নামে এরকম পীড়ন করা হয় কিনা। তিনি আমার কাছে দুঃখ করে বলেন, ‘এই নামি চাকরি নিয়ে বড়ো ভুল করেছি। ট্রেনিং পিরিয়ডে ছোটো ছোটো স্কুলে পড়াতে যেতাম — সেখানে ছাত্রসংখ্যা কম, গরিব পরিবার থেকে বাচ্চারা আসে, স্কুলের অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু এই পরিমাণ অত্যাচার করতে হয় না। এখানে তো পড়ানোটা কাজ নয়, চুপ করিয়ে রাখাটাই কাজ।’ ছাত্রদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার ‘অপরাধে’ নতুন শিক্ষককে বকা দেন সিনিয়র শিক্ষক। কোনো এক বিশেষ ‘সুশিক্ষিকা’ ক্লাস ওয়ানে রুমে ঢোকার আগে ভয়ে কাঁদতে থাকে সে ক্লাসের এক বাচ্চা। আমার সহকর্মী বিড় বিড় করে বলে — ‘জানিস তো, অচলায়তন কাকে বলে এখানে এসে শিখলাম’।
‘তোমাকে বন্ধ করে রেখে দেব’, ‘বাক্সে পুরে দূরে পাঠিয়ে দেব’, ‘খাঁচায় ভরে রেখে দেব চিড়িয়াখানায়’ কিংবা ‘গাছের ডালে তুলে দেব আর নামতে পারবে না’ — আমাদের মুখের এসব কথা বিশ্বাস করল মনে প্রাণে যে শিশুটি, তার কাছে ইস্কুলটা কী ভয়ানক রূপ নিয়ে হাজির হয়, ভাবলেও গা শিরিশির করে। আমার নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। ক্লাস ওয়ানে পড়াকালীন স্কুলে যাওয়ার আগে রোজ পেটে ব্যথা করত আমার, বদহজম হয়েছিল। খাবার নয়, বকুনি। সেই হজম না হওয়া বকুনির জের চলেছিল মাস চারেক।
তবু বীভৎস সব শাস্তির ভয়কে তোয়াক্কা না করেও রোজ অসংখ্য outlaw শিশু পেন ছুঁড়ে টিউবলাইট ভেঙে, বন্ধুর নাক ফাটিয়ে, অন্যের নামে মিথ্যে দোষ দিতে দিতে বড়ো হয়ে চলেছে। আমাদের সরকারের তরফ থেকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আমরা মানি না, আর আমরা যা শিক্ষা দিই তা মানে না আমাদের ছাত্ররা। আমাদের সুনিশ্চিত মাইনে আছে, তাদের আছে সুনিশ্চিত গৃহশিক্ষক ও টিউশন ক্লাস। ইস্কুলটা নাম-কা-ওয়াস্তে, সার্টিফিকেট জোগাড় করবার জায়গা মাত্র।
Leave a Reply