কুশল বসু, কলকাতা, ২৭ ফেব্রুয়ারি#
যে দেশে মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, যে কোন মুহুর্তে রাষ্ট্রীয় অথবা বেসরকারি সন্ত্রাসে মৃত্যুর আশংকা মানুষের– সেই দেশে কোন কিছু বলা বা করার কোন অর্থ নেই। শুধু পশুর মতো বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।
— ১৭ ফেব্রুয়ারির ফেসবুক স্ট্যাটাস, কল্লোল মুস্তাফা, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষার জাতীয় কমিটির সদস্য।
আক্ষরিক অর্থেই এখন বাংলাদেশের অবস্থা খুবই করুণ। গত ৫ জানুয়ারি দিনটিকে শাসক দলে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোট ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ ২০১৪ সালের ওইদিনই নির্বাচনের নামে এক প্রহসনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসে এরা। ফের প্রধানমন্ত্রী হন হাসিনা। আর ওই ৫ জানুয়ারি দিনটিকেই ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-র নেতৃত্বাধীন ২০ দলের জোট, যারা হাসিনা সরকারের ব্যাপক সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছিল। সেই থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসা। একদিকে বিরোধী জোট বাংলাদেশ জুড়ে অবরোধ ও হরতাল ডেকেছে। তারা চায় হাসিনা সরকারের আশু পতন ও সাধারণ নির্বাচন। বাংলাদেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে, কোনো মিটিং মিছিল করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিরোধীদের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচীও নেই। অবরোধের নামে মুড়ি মুড়কির মতো পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হচ্ছে বাস, পিক আপ ভ্যান, ট্রেন-এর ওপর। তাতে পুড়ে মরছে বা আহত হচ্ছে এক্কেবারে নিরীহ মানুষ। নাইট সার্ভিস বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে আগুন লাগানোর ঘটনা বাড়তে থাকায় নাইট সার্ভিসই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইকের পেছনে সওয়ারি নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় এসএমএস আদানপ্রদান নিষিদ্ধ হয়েছে। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচী নিষিদ্ধ। গণতন্ত্র নিয়ে সেমিনার করছে পুলিশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর পুলিশি সন্ত্রাসও চলছে। গুলি করে হত্যা করে গণপিটুনিতে হত্যা বলে চালাতে চাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত পুলিশ। সব মিলিয়ে প্রথম এক মাসের মধ্যেই শ-দেড়েক মানুষ মারা গেছে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যাঁতাকলে পড়ে সাধারণ মানুষ ‘পশুর মতো বেঁচে রয়েছে’।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে তথাকথিত নির্বাচনের পরেও একইরকম হিংসা সংগঠিত হয়েছিল। তখনও কয়েকশো মানুষ নিহত হয়েছিল।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়। সেই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে জড়ো হয়েছিল শ-খানেক যুবক যুবতী। তাদের দাবি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে দেশের মানুষকে হত্যা সহ আরো নৃশংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন নয়, ফাঁসি হোক। মুহুর্তে এই আওয়াজ ছড়িয়ে যায় দেশময়, মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক যুবতীদের আকর্ষণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারির শাহবাগ স্কোয়ার হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। যদিও শাহবাগের এই সক্রিয়তার বিপরীতে এক স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগারকে হত্যার মাধ্যমে দ্রুত সংগঠিত হয় ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতি — শাহবাগ আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ হিসেবে প্রতিপন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়। শাহবাগ আন্দোলন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষকে ছুঁতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং ক্রমশ বেশি বেশি করে শাসক দল আওয়ামি লিগের কাছাকাছি চলে আসায়, ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতি আরো সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। তৈরি হয় হেফাজতে ইসলাম নামে একটি জোট। যারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ‘ইসলাম অবমাননাকারী নাস্তিক ব্লগার’দের ফাঁসির দাবি নিয়ে ঢাকা শহর অবরোধের ডাক দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একই দাবিতে বিক্ষোভ ঘটাতে থাকে জামাত-ই-ইসলামি। কখনো কখনো তাকে সমর্থন জোগায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ‘ইসলাম অবমাননা’র ধুয়ো তুলে প্রবল এই বিক্ষোভ কোথাও কোথাও থানা আক্রমণ পর্যন্ত করে। বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনও প্রবল হিংসা দিয়ে একে দমন করতে থাকে। ফলে ট্রাইবুনালে প্রায় প্রতিটি রায় (বেশিরভাগই মৃত্যুদণ্ড) ঘোষণার পরপরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই সংঘর্ষে মাছি মশার মতো মরতে থাকে মানুষ। তাদের বেশিরভাগই মারা যায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। এর যথাযোগ্য নিন্দা না করে শাহবাগের আন্দোলনের মূল অংশটি নাগরিক আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির একটি অংশে পরিণত হয়।
এমতাবস্থায় ধেয়ে আসে সাধারণ নির্বাচন। আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমগ্ন আওয়ামি লিগ সরকারের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কথা ছিল — বেশিরভাগ জনমত সমীক্ষা সেরকম বলছিল, বিশেষত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো মিডিয়া ‘প্রথম আলো’র একটি সমীক্ষা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় বিরোধী দলগুলিকে প্রার্থী না দিতে দিয়ে, প্রচার না করতে দিয়ে এবং ভারত সহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলির বরাভয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামি লিগ।
অবশ্য ‘পশুর মতো বেঁচে থাকা’তেই অভ্যস্থ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। কয়েক বছর আগে তাজরিন ফ্যাশন নামক একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা যায় কয়েকশো শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই মহিলা। মালপত্র যাতে চুরি না যায়, তার জন্য মালিকের নির্দেশে কারখানা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তাই শ্রমিকরা বেরোতে পারেনি। শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীনই রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানার বহুতল ধ্বসে পড়ে মারা যায় সহস্রাধিক শ্রমিক, বেশিরভাগই মহিলা। আগের দিন ফাটল দেখা সত্ত্বেও জোর করে শ্রমিকদের কাজে ঢোকানো হয়েছিল। এই দুটি ঘটনাতেই মালিকরা সাদা চোখেই দোষী, কিন্তু তাজরিন ফ্যাশনস্-এর মালিক এরই মধ্যে জামিন পেয়ে গেছেন।
এই নিদারুণ বেঁচে থাকার পটভূমিতে নতুন একটি সংযোজন, ঢাকার সবচেয়ে বড়ো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ‘একুশে-র মেলা’র অদূরেই ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ন’টা নাগাদ নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন প্রবাসী ব্লগার অভিজিত রায়। তার স্ত্রীও আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। ধর্মবিশ্বাস বিরোধী লেখালেখির জন্য নিকট অতীতে একাধিক বার হুমকির মুখে পড়েছেন এই ব্লগার।
Leave a Reply