রঞ্জন, কলকাতা, ৩ ডিসেম্বর#
এমন একটা অনুভূতি নিয়েই ‘আশারি’র গেট পেরিয়ে হাঁটছিলাম শমীক আর আমি। কলকাতার পূর্বপ্রান্তে বিখ্যাত আর এন টেগোর হাসপাতাল পেরিয়ে সামান্য এগোলেই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পশুপাখিদের আস্তানা আর শুশ্রূষা কেন্দ্র আশারি। সময়ের হিসেবে বেশ পুরোনো, সরকার আর বেশ কিছু বড়ো বড়ো শিল্প সংস্থার অনুদানে তৈরি।
শহরায়নের ধাক্কায় সবদিক থেকেই কোণঠাসা অসহায় হয়ে পড়া পরিবেশের বাসিন্দা যেসব প্রাণীদের অসহায় অবস্থাটার মুখোমুখি হলে — আমরা যারা অনুভূতিগুলোকে এখনো অসম্মান করতে পারি না কিছু না কিছু চেষ্টা করি, উপায় হাতড়াই — ওদেরও কী করে বেঁচে থাকার নূন্যতম ব্যবস্থা কিছু করা যায় — সে কাজের বেলায় আশারির নামডাক শুনে বেশ আশান্বিত হয়েই ৩ ডিসেম্বর দুপুরে ‘মন্থন’ পত্রিকার শমীক আর আমি পৌঁছালাম ওখানে।
বেশ বড়োসড়ো ছড়ানো এলাকায় আশারি, পাঁচিল ঘেরা, সামনে সিকিউরিটি। ভেতরে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, পুকুর। চিড়িয়াখানার মতোই বেশ বড়োসড়ো একটানা লম্বা খাঁচা রয়েছে আর ভেতর থেকে আসছে কুকুরের একটানা একটা করুণ গোঙ্গানি।
খাঁচা পেরিয়ে বরাবর সোজা হাঁটলে — একটা জায়গায় পশুচিকিৎসার আউটডোর। ডাক্তারবাবুরা তখন নেই। মনে হয় অত দুপুরে চিকিৎসা শেষই হয়ে গেছে।
আবার একটু এগোলে আরও কিছু খাঁচা। কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সামনের দিকে বেরিয়েও এল কয়েকজন। বোঝাই যায় বেশ অসুস্থ। প্রায়ই যেমন হয়, মাথায় ঘাড়ে ঘা এমন একজনকে নজরে পড়ল। সংক্রমণ আছে মনে হল। গলাও ভেঙ্গে গেছে, ডাকছে বেশ করুণ গলাতেই।
এতক্ষণে কয়েকটা বিড়াল আর কুকুরকে খোলা অবস্থায় পাওয়া গেল। হয়তো সুস্থ হয়ে গেছে, তবে স্বাস্থ্য সবারই বেশ খারাপ। পৌঁছলাম, অনুসন্ধান অফিসে। এখানে কয়েকজন মহিলা আছেন — সকলেই ব্যস্ত, তবু আমাদের আসার কারণ জানতে চাওয়ায়, আমাদের কৌতুহল মেটাতেই চাইলাম, ওঁরাও উত্তর দিলেন।
ওঁদের কাছে জানতে চাই – শহর জুড়েই যে মানুষ বাদে অন্য এইসব প্রাণীগুলোর নানান অসুখ, অসহায়তা আর দুর্ঘটনাজনিত আঘাত পাওয়া ঘটেই চলে, ওঁরা সেসব ক্ষেত্রে কী করেন? উত্তরে দায়িত্বে যিনি আছেন, শ্যামলিদি, বললেন, খবর পাঠালে ওঁরা ঘটনাস্থলে গিয়েই রোগীর চিকিৎসা করেন। রোগীর অবস্থা খারাপ থাকলে তাদের নিয়েও আসা হয়। সেক্ষেত্রে ভর্তি করাতে ১৫০০ টাকা জমা রাখতে হয়। এছাড়া আম্বুলেন্স ব্যবহারের জন্যে ২০০০ টাকা আর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে সহানুভূতিশীল মানুষদের পক্ষে যা সম্ভব তেমন অনুদানও নেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে গেলে প্রাণীটিকে সেই এলাকাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়াও টীকাকরণ, লাইগেশনও করেন তারা। এসব ক্ষেত্রেও ১৫০০ টাকা জমা, গাড়িভাড়া ২০০০ টাকা ও চিকিৎসার জন্য অনুদান নেওয়া হয়।
ওঁরা বললেন যেহেতু এটা সরকারি সংস্থা নয়, তাই এভাবেই মানুষের ব্যক্তিগত সহায়তা উদ্যোগেরই মাধ্যমে কাজ চালিয়ে চলেছেন ওঁরা।
এরপর আমি জানতে চাই — পাড়ায় পাড়ায় এত যে বাচ্চা হয়েই চলেছে প্রত্যেক বছর — বিড়াল বা কুকুরদের, মারাও পড়েছে নানাভাবে তাদের কোনোরকম রাখার ব্যবস্থা হয় কিনা — ওঁরা বললেন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই, আর এক্ষেত্রে বাচ্চা হওয়া যাতে বন্ধ করা যায় তেমন ব্যবস্থার সাহায্য নেওয়াই ভালো।
শমীক জানতে চাইল — বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে দেওয়ালিতে এদের মধ্যে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে কোনোরকম অস্থায়ী শেল্টারের ব্যবস্থা এখানে সম্ভব কিনা।
ওঁরা জানালেন — ১৫ দিনের ব্যবস্থা হয়। তবে এক্ষেত্রে ৭০০ টাকা জমা দিতে হয়। আশারিতে কুকুর, বিড়াল, গরু, পুকুরে মাছ এবং পাখিদেরও থাকা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত রয়েছে। কিছু চিলকেও রাখা হয়েছে।
এরপর আমরা জানতে চাই — কোনো পশুপ্রেমী মানুষ কি পারেন এসব প্রাণীদের কাউকে দত্তক নিতে? নিজের কাছে রেখে পালতে? এক্ষেত্রে গরুদের কথা একটু জোর দিয়েই বলি। ওঁরা জানিয়ে দিলেন — এমন কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। এখানকার কোনো প্রাণীকেই ব্যক্তিগত ভাবে পালন করা যাবে না।
এবার ওঁদের অনুমতি নিয়েই আবার একটু ঘুরে দেখতে বেরোই আমরা। প্রাণীরা কে কেমন আছে? কারোরই শরীর স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নয়। আর যা নজরে পড়েছে সর্বত্রই সবার কেমন একটা ঝিমুনি ভাব। যে কোনো কারণেই কারো প্রাণময়তার তত ছাপ নেই। এরপর একটা ঘেরা জায়গায় দেখলাম চিলদের রাখা হয়েছে। কিছু লোক এটাকে জাল দিয়ে ঘেরা ও সংস্কারের কাজ করছিল। আমরা কৌতূহলী হই চিলগুলো কীভাবে এল বা আনা হল তা জানতে। তারা অবশ্য তেমন কিছুই জানে না। সুস্থ হলে ওদের কী করা হয়? অজানা রইল এর উত্তরও। একটু খারাপই লাগল চিলের মতো পাখির এই খাঁচার বন্দিদশা দেখে।
ফিরতে ফিরতে দেখলাম এখানে ওখানে মৃত প্রাণীগুলোর কিছু কিছু কবর। কেমন মনে হচ্ছিল — খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ, চিকিৎসা আর ঠাঁই মিললেও আশারির পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দির আড়ালে ওরাও যেন কিছুটা যাবজ্জীবন মেয়াদই ভোগ করছে।
Leave a Reply