৩১ মে, শাকিল মহিনউদ্দিন, হাজিরতন, মেটেবুরুজ#
মেটেবুরুজের সফির কাঠগোলার বাসিন্দা হাজী মফিজুল ইসলাম মোল্লা। বয়স সবেমাত্র পঞ্চাশ। তিনি একজন পর্যটক। দর্জি মহল্লায় এরকম স্বভাবের মানুষ বিরল। খোঁজ-খবর করাই তাঁর স্বভাব। তাঁর কাছে গেলে পাওয়া যায় কাঠকাটা কাঠুরে, মাছধরা জেলে আর ডাবওয়ালাদের খবর। যখন ভ্রমণ করেন, আশপাশের ঘুরঘুর করা চলমান মানুষ কিংবা প্রত্যন্ত বাঁশচালার বস্তিবাসীদের খোঁজ নেন বারেবারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখ জুড়ানো শান্তির পাশে ওই প্রান্তিক মানুষের দিনলিপি তাঁর দু-চোখে বন্যা বইয়ে দেয়। সরকারি জনগণনায় হয়তো একশো বাইশ কোটির বাইরেই এরা, কিংবা নামই নেই এদের, তবু মফিজুল ইসলামের মনের গণনায় এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জনপদগুলোতে কাজে-অকাজে ঘুরে চলেছেন তিনি। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে কয়েকবার ওঁর পর্যটন-সঙ্গী হয়েছি। অতি সম্প্রতি সফর করে এসেছেন দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরু, মহীশূর, চেন্নাই, কেরালা ও কন্যাকুমারী। আগেও এসব জায়গায় গেছেন। তাঁর কাটছাঁট কথা — ণ্ণরথ দেখা কলা বেচা না হলে ভ্রমণের সার্থকতা অপূর্ণই থেকে যায়’। কলা বেচাটা আবার কী? তাঁর কথায়, এ হল চলার পথে ওই প্রান্তিক নিম্নবর্গের মানুষের টুকিটাকি খোঁজখবর নেওয়া।
ব্যবসায়িক কাজে তো বটেই, বছরে দু-একটা সফর তাঁর লেগেই আছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়িয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন আয়লার ঝড়ে বিধ্বস্ত গ্রামবাসীর হাল-হকিকত। এই বয়সেই এত ঘুরেছেন, তবু বিনয় করে বলেন, ‘বিশাল ভারতের মহামানবের সাগরতীরের দু-একটা নুড়িই সংগ্রহ করা যায় মাত্র, তার বেশি তো নয়!’
‘বাঙালিরা খুব আলাপপ্রিয়, আপন করে নিতে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার’ — কথাগুলো বলেই তিনি অকপটে জানালেন, দক্ষিণের আলাপচারিতার কায়দাটা অনেকটাই আমাদের মতো। তবে ওরা আলাপ করতে করতে নিজেদের কাজের কথাটা ভুলে যায় না। মুখে তাদের মিষ্টি কথা। কিন্তু হাতটা কর্মব্যস্ত আর অসম্ভব নিষ্ঠা। এটাই ওদের বৈশিষ্ট্য। কর্মের প্রতি ওদের নিষ্ঠা দেখার মতো। যে যার দায়িত্ব অচিরেই পালন করে যায়। ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা ওদের নেই, যা আমাদের রাজ্যে সর্বত্র চোখে পড়ে। কাউকে বলে দিতে হয় না — যেন একটা সহজাত ব্যাপার, করতে পারলেই ওরা খুশি। ফেরিওয়ালা, ছোটো দোকানদার, মৎস্যজীবী, হোটেলের কর্মচারী হিসেবে এরা নিযুক্ত। লাজলজ্জা-সম্ভ্রম ওদের পুঁজি। সেই পুঁজিকে পাথেয় করে মরতে মরতেও ওরা আজ সজীব, জলে খেলে যাওয়া মাছেদের মতোই। আইনকানুন মেনে চলা ওদের স্বাভাবিক অভ্যাস। দোকানদারদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে — ওজন সঠিক দিতে হবে। কোনো গলদ হলে জরিমানাও জবরদস্ত! তার বহর এতটাই যে ব্যবসাটাই লাটে উঠবে!
এইসব ভারী ভারী কথার মধ্যেও চলে আসে দক্ষিণীদের খাওয়াদাওয়ার রসের কথা। সমস্ত খাবারে সুস্বাদু নারকেল আর পাকা কলার চপ নাকি ওদের দারুণ পছন্দ।
Leave a Reply