দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য, কোচবিহার, ২১ নভেম্বর#
সেদিন সকাল থেকেই মেঘ করেছিল। তবুও কোচবিহারের টাকাগাছের নেতাজী সুভাষ ফ্রী কোচিং সেন্টারে যাওয়ার জন্যে সকাল ৬.৩০ নাগাদ বেড়িয়ে পরলাম বাড়ি থেকে, কারন তারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজকর্ম শুরু করে দেয়, সেই জন্যে আমাকেও অনেক তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে হল। আমি আমার বন্ধু ঋজু আর সোমনাথের মুখে এই সেন্টারের নাম শুনেছিলাম, আর সোমনাথ যেহেতু এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাই তার কাছে বিস্তারিত ভাবে জেনেছিলাম। ২০০৭ সালের ১৪ই জুন আর্থিকভাবে তলানিতে থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই সেন্টার যখন চালু হয় কেউই সেভাবে উৎসাহিত হতে পারেননি। তখন ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৫, গত ৫-৬ বছরে সংখ্যাটা ১৮০ ছাড়িয়ে ২০০ ছুঁইছুঁই। সপ্তাহে চারদিন ক্লাস হয়, সকাল ৬.৩০ থেকে ৯.১৫ আর রবিবার ১০.৩০ পর্যন্ত। ছেলেমেয়েগুলো এতোটাই গরীব যে লন্ঠন কেনারও টাকা নেই তাদের কাছে। এই সেন্টার থেকেই তাদের নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়, আবার তার ক্ষমতাও তো সীমিত। বাদল ঘোষ, অমল চক্রবর্ত্তী, হরিশ্চন্দ্র রায় বা কমল বর্মন মহাশয়ের মত বয়স্ক শিক্ষকদের ডাকে সারা দিয়ে এগিয়ে এসেছে শ্যামল, সঞ্জীব, বাপ্পাদিত্য, জয়া, মৌমিতার মত কলেজে পড়া বা সদ্য কলেজ থেকে পাস করা ছেলেমেয়েরা, সন্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলছে এই সেন্টার। শুধু এই সেন্টারের কারনে আশেপাসের ৩-৪ টি স্কুল এর স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা লক্ষ্যনীয়ভাবে কমে গিয়েছে। এসব শুনে কিছুটা উৎসাহিত হলেও মনে অনেক প্রশ্ন আর সংশয় ছিল, সেটা দূর করতেই আমার সাইকেলটা নিয়ে রওনা দিলাম। ভবানী সিনেমা হলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে সোজা গিয়ে বাঁধ পেড়িয়ে টাকাগাছের দিকে রওনা দিলাম। কোচবিহারে থাকলেও এদিকে বেশী আসা হত না। এখানকার কয়েজন সহপাঠীর কথা এখনও মনে করতে পারি। তারা কেউই সেরকম বড় ঘর বা শিক্ষিত পরিবার থেকে আসা নয়। তাদের বাবামায়েরা বাইরের জগৎ বা পড়াশোনা সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ ছিলেন, জায়গাটাকে আমরা গ্রাম বলতাম। এতো সবকিছুর পরেও আমার সহপাঠীরা ছিল অসাধারন মেধাবী। তারা ভীষনভাবে অভাবী ছিল, তাদের বাবামায়েরা পড়াশোনা জানতেনই না বলতে গেলে, কিন্তু তারপরও তারা হিংসে করার মত ফলাফল করতো।
কিছুক্ষন চলার পর দেখলাম একটা সরকারী প্রাইমারী স্কুল তাতে ‘নেতাজী সুভাষ ফ্রী কোচিং সেন্টার’ এর একটা ফেস্টুন দেখলাম। আমি সেখানে গেলাম, বাদল ঘোষ মহাশয়ের কাছে জানলাম প্রাইমারী স্কুলের এ.আই. এর কাছে অনুমতি নিয়ে স্কুল শুরু হওয়ার আগে এখানে পড়াশোনা করানো হয়। আমি ছাত্র-ছাত্রী সাথে কথা বললাম। আর একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম যে এই অঞ্চল থেকে পড়তে যাওয়া আমার সহপাঠীদের সাথে এদের কোনও তুলনাই করা যায় না। আমার সহপাঠীরা অন্তত বইখাতা বা অন্যান্য জিনিস্পত্র কেনার মত জায়গায় ছিল, এরা সেই জায়গাতেই নেই। কাউকে কাউকে এটাও দেখলাম খাতায় প্রথমে পেন্সিল দিয়ে লিখে শেষ করে তার উপর পেন দিয়ে লিখছে। তারা খুব উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে কথা বলল। কেউ কেউ সারাদিন কাজ করে, অনেকের মা লোকের বাড়িতে কাজ করে, তাদেরকেও যেতে হয়। কেউ কেউ কৃষিজমিতে শ্রমিকের কাজ করে (যদিও জাতীয় শিশু দিবসে ফেসবুক ভরে যায় শিশুশ্রমিকের ছবি আর দুঃখপ্রকাশে), কারো মা হোটেল এ মশলা বাঁটে, বাসন মাজে – তাদের ও অনেকদিন এ যেতে হয়। বেঁচে থাকার তাগিদের কাছে হার মানে পড়াশোনা (হায়রে শিক্ষার অধিকার)। আমার সহপাঠীরা অন্তত জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডীক্যাল কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখতো – এদের কাছে সেই স্বপ্ন দেখাটাও বিড়ম্বনার ব্যাপার।
এভাবেই চলছে নেতাজী সুভাষ ফ্রী কোচিং সেন্টার, এতোকিছুর পরেও ৩টে মাধ্যমিক পার হয়ে গেল, একজনও ফেল করেনি, প্রথম বিভাগেও পাস করেছে কয়েকজন। তারা এখন কেউ কেউ স্কুলে আর কয়েকজন তো কলেজেও পড়ছে। বিনেপয়সায় পড়াতে আসা শিক্ষক শিক্ষিকাদের চোখে আমি দেখেছিলাম প্রত্যয় – আরো এগিয়ে যাওয়ার।পথ হারাতে চলা শিশুদের পথ দেখানোর প্রত্যয়। ফিরে আসার সময়ে হিংসে হচ্ছিল – আমিও যদি থাকতে পারতাম ঐ শিক্ষকদের দলে।
Leave a Reply