তমাল ভৌমিক, কলকাতা, ১৪ মার্চ#
‘তবু বাংলার মুখ’-এর দ্বাদশবর্ষে প্রকাশিত ‘বইমেলা সংখ্যা : ২০১৩’ হাতে এসেছে। ১০ টাকা দামের ৪৮ পাতার এই লিটল ম্যাগাজিন সর্বতোভাবেই প্রবন্ধের এবং এর মূল বিষয় : বাংলা ও বাঙালি। ‘দেশভাগের বিনির্মাণ’ প্রবন্ধে অসিত রায় দেশভাগের আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে ‘দেশভাগের জন্য জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বই নয়, গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলের ক্যাবিনেট-মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও দায়ী এবং ক্ষমতালোভী, স্বৈরতন্ত্রী, বর্ণবাদী দিল্লির শাসকরাই দেশভাগ করেছিল একটা শক্ত কেন্দ্র ও দুর্বল প্রদেশ গড়ে ভারত সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের আদর্শভিত্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। এর ফলে ‘ভারতের অঙ্গরাজ্যে জাতি পরিচয়হীন ৯ কোটি বাঙালি পৃথিবীর বৃত্তম জাতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষুদ্রতম জাতির চেয়েও করুণ অবস্থায়’ আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষ ‘বহুজাতিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, গভীর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে, এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে …। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উত্থান সারা বিশ্বের বাঙালিকে সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে এক নতুন ইতিহাসের পথ দেখাচ্ছে। মজার কথা হল, অসিত রায়ের এই লেখা যখন রচিত হয়েছে, তখনও বাংলাদেশের শাহবাগের আন্দোলন শুরু হয়নি। অথচ শেষের কথাটা কেমন সাম্প্রতিক এই ঘটনার সঙ্গে মিলে গেল। যেন প্রতিধ্বনি আগে আর ধ্বনিটি পরে শোনা যাচ্ছে। আসলে তা নয়। যে ‘ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন’-এর কথা অসিত রায় বলছেন তা ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। সেই অর্জিত বিজয় রক্ষিত থাকেনি এবং তার লড়াই এখনও চলছে, এটাই ঘটনা। শাহবাগের আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এটাই দেখাচ্ছে।
‘ভারতে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্র’ নিবন্ধে মলয় বসু ভারতে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অসারতা তুলে ধরে শেষে খানিকটা আশার আলো দেখিয়েছেন যে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। বিগত এক দশক ধরে আমরা দেখছি, এই পরিবর্তনের লক্ষণ। একদিকে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের বুলি, অন্যদিকে তথাকথিত সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি মানুষের মোহ কাটতে শুরু করেছে। শাসক বিরোধী নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক মাতব্বরদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণমানসে জন্মেছে ঘৃণা আর হতাশা।’ এরই চিহ্ন মলয় বসু খুঁজে পেয়েছেন ‘কাশ্মীর বা মণিপুরের মতো প্রান্তিক মানুষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে’, ‘আদিবাসীদের মতো সমাজের নিম্নতম প্রান্তিক মানুষরা হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ায়’ আর ‘সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মতো কৃষক সংগ্রাম, মেকি বামপন্থীদের কবর রচনা করায়’। এরপরে তিনি উপসংহার টেনেছেন এই বলে, ‘এমতাবস্থায় আজ বিশেষ প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজ। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।’ ‘শক্তিশালী নাগরিক সমাজ মানে কী, কোন ইতিহাসের এই শিক্ষা, তা কিন্তু ঠিক বোঝা গেল না।
দুটি প্রবন্ধ আছে বাঙালিদের নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া নিয়ে — ‘নিজভূমে ছিটমহলের অনাগরিক বাসিন্দা’ (পশ্চিমবঙ্গ পিইউসিএল) এবং ‘ভারতের নাগরিক আইন ও বাঙালি’ (কুমুদরঞ্জন বিশ্বাস)। ইংরেজি ও হিন্দির দাপটে বাংলাভাষার সংকট নিয়ে লিখেছেন নীতিশ বিশ্বাস ও স্বপন মজুমদার। পার্থ বসু ও কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সুভাষ দাস, সংখ্যালঘু সংরক্ষণ সম্পর্কে এমদাদুল হক লিখেছেন। ‘নজরুল ফাউন্ডেশন : অখণ্ডতার ঐকান্তিক প্রয়াস’ বিষয়ে লিখেছেন মূর্শিদ এ এম। রঙ্গলোকের পরশপাথর নাট্যসমালোচনা করেছেন অরূপ শঙ্কর মৈত্র। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার ব্যঞ্জনায় গোলাম মূর্তাজা লিখেছেন, ‘দেশকে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু ভাগ হননি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল’। আবার, রবীন্দ্রনাথ সহ দ্বিজেন্দ্রলাল, শরৎচন্দ্র সত্যেন দত্তকে একেবারে ধরে ধরে সমালোচনায় বিভক্ত করে ‘নজরুলকে, বাঙালি জাতির ধ্রুবতারা বানানোর একটি প্রস্তাবনা’ পেশ করেছেন বিশ্বময় চৌধুরি যা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। প্রতিদিন পত্রিকায় সূত্রে নবনীতা দেবসেনের লেখা ‘শ্যামলীদির চালচিত্র’ এবং গৌতম চৌধুরির সূত্রে ফরহাদ মাজহারের লেখা ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে যত্রতত্র আরবি ঢুকে গেছে!’ পত্রিকাকে ঋদ্ধ করেছে। বিশেষত শেষোক্ত প্রবন্ধে বাণী বসুর বাণী (যা শিরোনামেই আছে) সম্পর্কে লেখকের এই ব্যাখ্যা মনে রাখার মতো — ‘শেষাবধি এই অসুখ সাইকোলজিকাল নয় — এমনকী তার প্রকাশ অনেক সময় সাম্প্রদায়িক মুসলমানের মামলাও নয়, বরং বর্ণ ও শ্রেণীর মামলা। … সমাজের নিচের তলার মানুষগুলোর ভাষা যখন — বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিতে চাইছে … তখনই এই অসুখ ধরা পড়তে শুরু করেছে।’
হালকা সবুজ কাগজে মোড়া এই পত্রিকার প্রচ্ছদে ইমরান হোসেন পিপলুর ছবি খুব সুন্দর মানিয়েছে। শেষ প্রচ্ছদে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তর কবিতা ‘পুব-পশ্চিম’ও। তবে বাংলা ভাষা যে পত্রিকায় এতটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে তাদের বানানের ভুল বা মুদ্রণপ্রমাদের এত আধিক্য মেনে নেওয়া যায় না।
Leave a Reply