৩০ মার্চ উচ্ছেদের পর নোনাডাঙার মজদুর কলোনি এবং শ্রমিক কলোনির বাসিন্দাদের অনেকেই ঝড় জল বজ্রপাতের মধ্যেই ওই মাঠের মধ্যে থাকতে শুরু করে, কোনওমতে কুঁজিটুকু তুলে। একটি রান্নাঘর তৈরি করে সেখানে সবার খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল উচ্ছেদবিরোধী কর্মীদের ব্যবস্থাপনায়। ৪ এপ্রিল উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে ণ্ণউচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র নেতৃত্বে একটি মিছিল নোনাডাঙা থেকে এসে ইএম বাইপাসে রুবি মোড়ের কাছে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখায়। সেই সময় পুলিশ মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করে। এক গর্ভবতী মহিলা সহ অনেকে আহত হন।
৮ এপ্রিল সকাল থেকে রুবির মোড়ে অবস্থান শুরু হয়েছিল ণ্ণউচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র। পুলিশ গিয়ে সেই অবস্থান ভেঙে দিয়ে ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করে লালবাজারে নিয়ে যায়। পরে ৬২ জনকে ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দিলেও ৭ জন কর্মীকে আটকে রাখে এবং পরদিন আলিপুর কোর্টে পেশ করে নোনাডাঙায় অস্ত্রশস্ত্র জমা করার অভিযোগ আনে। এই সাতজনের নাম : অভিজ্ঞান সরকার, দেবযানী ঘোষ, দেবলীনা চক্রবর্তী, পার্থসারথি রায়, মানস চ্যাটার্জি, শমীক চক্রবর্তী এবং সিদ্ধার্থ গুপ্ত। যদিও পুলিশ প্রথমে এই অভিযোগ আনেনি, ৪ তারিখে রুবির মোড়ে পথ অবরোধ, কর্তব্যরত সরকারি অফিসারের কাজে বাধা দেওয়া প্রভৃতি অভিযোগ ছিল। আলিপুর কোর্ট ধৃতদের তিনদিনের পুলিশি হেফাজত দেয়। ৯ এপ্রিল উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের পুনর্বাসন এবং ধৃতদের মুক্তির দাবিতে কলেজ স্কোয়ার থেকে মহাকরণ অবধি একটি মিছিল ডেকেছিল উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, সেই মিছিলটি শুরু হতেই পুলিশ ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করে লালবাজারে নিয়ে যায়, যার মধ্যে ৫০ জন পুরুষ, ৩৬ জন মহিলা ও ৫ জন শিশু। পরে রাতের দিকে সবাইকে ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল আলিপুর কোর্ট পুলিশি হেফাজতে থাকা ধৃতদের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে এবং ছয় জনের জেল হেফাজত দেয় ও একজনের সিআইডি হেফাজত দেয়।
১১ এপ্রিল থেকে নোনাডাঙার মাঠে যেখানে যৌথ রান্নাঘর বসেছিল, সেখানে ৬০ জন উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসী এবং উচ্ছেদ বিরোধী কর্মী অনশন অবস্থান শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ৯ জন বস্তিবাসী এবং একজন উচ্ছেদ বিরোধী কর্মী অনশন চালিয়ে যেতে থাকে। এই দশজনের নাম : উজ্জ্বল সাহা, পূর্ণ মণ্ডল, রাজকুমার নস্কর, বিধুভূষণ নস্কর, সঞ্জয় সরকার, মধু হালদার, লখিন্দর হালদার, আনোয়ার মণ্ডল, মালবিকা দাস এবং অমিতাভ ভট্টাচার্য।
এদিকে উচ্ছেদকারী সংস্থা কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের অধীন) নিযুক্ত করা কন্ট্রাকটর উচ্ছেদ হওয়া মাঠটিকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ করতে শুরু করে। এলাকার পুরোনো বেসরকারি উদ্যোগের স্কুল বান্ধব জনকল্যাণ সমিতির ণ্ণমহাশ্বেতা দেবী পাঠশালা’টির বেড়ার ঘর কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্পের রূপ নেয়। এই সমিতি নোনাডাঙার পুনর্বাসন পাওয়া ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের স্বার্থবাহী একটি সংগঠন। ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যেবেলা তৃণমূল কংগ্রেস নোনাডাঙায় মিছিল ও পথসভা করে, এবং সেখান থেকে এলাকার বাসিন্দা (কলকাতার বিভিন্ন ঝুপড়ি বস্তি থেকে পুনর্বাসন পাওয়া ফ্ল্যাটবাসী) দের ডাক দেয় অনশন অবস্থান ও অস্থায়ী কুঁজি বানিয়ে মাঠের ভেতর থাকা উচ্ছিন্ন বস্তিবাসীদের তুলে দেওয়ার জন্য। মিছিলে ফ্ল্যাটবাসী ছাড়াও আশেপাশের তুলনায় পুরোনো কিছু বস্তির বাসিন্দারাও ছিল।
এরকমই এক বস্তি, লেক পল্লির বাসিন্দারা পাঁচটি দোকান দিয়েছিল মজদুর কলোনি বস্তির পাশে মাঠের ধার দিয়ে। ১৪ এপ্রিল কেএমডিএ একটি বুলডোজার নিয়ে এসে সেই দোকানগুলি ভেঙে দেয়, কারণ সেখান দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে মাঠটিকে ঘেরার জন্য। সেদিনই সকাল থেকে আশেপাশের পুনর্বাসন ফ্ল্যাটের কিছু বাসিন্দা, বিশেষত মহিলা, মাঠে এসে উচ্ছিন্ন বস্তিবাসীদের গালমন্দ করতে থাকে এই বলে, ণ্ণতিন মাস এসে বসেই ফ্ল্যাট নিতে চায়। … আমরা বিশ ত্রিশ বছর কলকাতায় বস্তিতে থেকে তবে ফ্ল্যাট পেয়েছি।’
উচ্ছেদ হওয়া বস্তির সবচেয়ে কাছের দুটি তুলনায় পুরনো বস্তি ভাই ভাই কলোনি এবং লেকপল্লি। উচ্ছেদের আগে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির কাছে মজদুর কলোনি এবং শ্রমিক কলোনির মানুষেরা যথাক্রমে ৯৪ এবং ৪৫টি নাম জমা দিয়েছিল, ওই কলোনি দুটির বাসিন্দা হিসেবে। এই শ্রমিক কলোনির বেশ কিছু ঘর এবং মজদুর কলোনির কয়েকটি ঘর গত বছর জুন মাসে ভেঙে দিয়েছিল নোনাডাঙারই কিছু নেতা, লোকজন জুটিয়ে এনে। আরতি সর্দার, একাদশী নস্কর, মঙ্গলা মণ্ডল, মায়া সর্দার প্রভৃতিরা তখন একবার ঘরছাড়া হয়েছিল।
পুরোনো বস্তি নতুন বস্তি, বস্তি এবং পুনর্বাসনের ফ্ল্যাটবাসী — নোনাডাঙায় গরিব খেটে খাওয়া মানুষের বিভাজনের এইগুলি কিছু দিক। তাছাড়াও আছে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু এবং এপার বাংলার লোকের বিভাজন। নোনাডাঙার হাওয়ায় উড়ছে কথা, বিভিন্ন বস্তির বাংলাদেশের উদ্বাস্তু বাসিন্দাদের নাকি চৌদ্দ ছটাক করে জমি দেওয়া হবে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর থেকে। যদিও সাধারণভাবে শহরের গরিব মানুষের জন্য অধুনা সরকারি স্কিম হল ণ্ণজওহরলাল নেহেরু আরবান রিনিউয়াল মিশনে’র তত্ত্বাবধানে ণ্ণবেসিক সার্ভিস ফর আরবান পুওর (বিএসইউপি)’ প্রকল্পের এক কামরার ফ্ল্যাট। এই নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বস্তির এপার বাংলার বাসিন্দারা।
এইসব বিভাজন আর শহর কলকাতায় মাথাটুকু গোঁজা ঠাঁইয়ের চিন্তা নিয়েই লোভ-আশা-আশঙ্কায় রয়েছে নোনাডাঙার বিভিন্ন বস্তির কয়েক হাজার মানুষ। যারা গ্রামগঞ্জ থেকে পেটের টানে ভাসতে ভাসতে কলকাতা শহরে এসেছে আজ বা কাল। কেউ ভ্যান টানে, কেউ পাইপ, রং, বিল্ডিং বা ইলেকট্রিকের কাজ করে, কেউ বাড়ির কাজ।
সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, নোনাডাঙা, ১৪ এপ্রিল
Leave a Reply