কুশল বসু, কলকাতা, ৩০ মে#
এ বছর এভারেস্ট-এ বিপর্যয়ে ষোলো জন শেরপার প্রাণহানি এবং তারপর শেরপাদের সম্মিলিতভাবে এই মরশুমে আর এভারেস্ট অভিযানে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। তা হলো আগের বছর ২০১৩ সালে এপ্রিল মাসে ২ নং ক্যাম্পে ঘটে যাওয়া একটা মারপিট — পশ্চিমী অভিযাত্রী তথা গাইড তথা হেলিকপ্টার চালক তথা এভারেস্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় শেরপাদের। এই ঘটনার প্রাথমিক বিবরণগুলো সবই পাওয়া যাচ্ছিল পশ্চিমী অভিযাত্রীদের বয়ান অনুযায়ী — বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেই নিয়েই লেখা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে একজন শেরপার সঙ্গে কথা বলেন এক নেপালি সাংবাদিক এবং পরে তা বেরোয় ইংরেজি অনুবাদ হয়ে। শেরপাদের বয়ান প্রায় পাওয়াই যায় না, কিন্তু এই বয়ান অনুযায়ী ঘটনাটি দেখলে হিমালয়ে পর্বতারোহণ ব্যবসা, অভিযাত্রী এবং শেরপাদের মধ্যে এক দীর্ঘকালীন সংঘর্ষের আঁচ পাওয়া যায়। সম্প্রতি কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে ছন্দা গায়েন এবং দাওয়া ও তেম্বা নামে দুই শেরপা-র মৃত্যুর ঘটনায় এভারেস্ট ব্যবসা আরো নজরে এসেছে।
এভারেস্টে দুই ধরনের অভিযান হয়। বেশিরভাগই হয় এক্সপিডিশন স্টাইলে। এই কায়দাতে শেরপারা পথ খুঁজে বের করে, সেই পথ বরাবর মই আর দড়ি পেতে দিয়ে আসে প্রথমে। তারপর অভিযাত্রীদের মূল অভিযান শুরু হয়। মই আর দড়ি পাতার সময় সমস্ত ভ্রমণ কোম্পানি (যারা বিভিন্ন অভিযাত্রীদের লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এভারেস্ট জয় বরাত নিয়ে থাকে) থেকে প্রতিনিধি থাকে, তাদের শেরপারা মিলেমিশে এই দড়ি পাতে। আর এক ধরনের অভিযান হয়, খুব পাকা পর্বতারোহীরা যেটা করে, আলপাইন স্টাইল। এতে অভিযাত্রীরা কোনো পাতা দড়ি মই ছাড়া এবং শেরপাদের সাহায্য ছাড়া নিজেরাই ওঠে। অনেক সময় অক্সিজেনও নেওয়া হয় না।
২০১৩-র এপ্রিলে মিংমা শেরপা-র নেতৃত্বে ২ নং এবং ৩ নং ক্যাম্পের মাঝখানে বিপজ্জনক জায়গায় দড়ি পাতছিল শেরপারা। এই দড়ি পাতার সময় তারা নিজেরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তাই তারা আগের দিনের মিটিং-এ সব টিমকে বারণ করে দিয়েছিল ওই সময় যেন কেউ ওই রাস্তা দিয়ে ওপরে না উঠে পড়ে। কেউ ওপরে উঠে পড়লে তার পায়ের চাপে ওপরের বরফ আলগা হয়ে ঝড়ে পড়তে পারে দড়ি পাততে থাকা শেরপাদের ওপর।
কিন্তু তাদের বারণ না শুনে তিনজন আলপাইন স্টাইলে অভিযান করতে চাওয়া পশ্চিমী অভিযাত্রী উঠে পড়ে ওপরে। তাদের পায়ের চাপে বরফখণ্ড ছিটকে এসে লাগে দড়ি পাততে থাকা শেরপাদের মুখে, একজন আহত হয়। শেরপাদের দড়ি পাতা ওই দিনের মতো বাতিল করতে হয়। তারা ২ নং ক্যাম্পে ফিরে আসে। একইসঙ্গে যে তিনজন অভিযাত্রী ওপরে উঠে গিয়েছিল, তারাও ফিরে আসে, কারণ তারা আসলে লোৎসে যাবে পরদিন, ওইদিন একটু ওপরে উঠেছিল গা গরম করার জন্য। ফিরে আসার সময় শেরপাদের সর্দার মিংমার কলার চেপে ধরে গালিগালাজ করে ওই বিদেশীরা। শেরপারা ধেয়ে যায়, প্রায় একশ’ শেরপা ঘিরে ধরে ওই অভিযাত্রীদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে, কিছু কিল চড়-ও লাগায়।
ওই তিনজন বিদেশী আলপাইন কায়দার পর্বতারোহীদের নেতা ছিল সিমন মোরো। এই ইতালীয়টির ব্যবসা হলো এভারেস্ট। সে অন্যান্য পশ্চিমী টিমের গাইড হিসেবে কাজ করে, হেলিকপ্টার করে উদ্ধারকার্য চালায় এভারেস্টে — এবং এই হেলিকপ্টার চালনার কাজে সেই একমাত্র অ-নেপালী। হেলিকপ্টার উদ্ধারকার্যের কোম্পানিতে তার শেয়ারও আছে। নেপালী শেরপা এবং উদ্ধারকারী পাইলটদের সে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে। পশ্চিমী অভিযাত্রী টিমগুলি এবং শেরপা ও নেপাল সরকারের ওপর তার প্রভাবের কারণে পর্বতারোহণের ব্লগগুলি তার নাম দিয়েছিল এভারেস্টের মালিক’।
শেরপাদের সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তারা ওই সিমন মোরো-র বিরুদ্ধে। ওই শেরপার বয়ান, সিমন নেপালে আসে রোজগার করতে; সে এই পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল। আগে, তার বিরোধিতা করার মতো কেউ ছিল না। শেরপারা ভয় পেত, মনে করত, সিমনকে চটালে কাজ চলে যাবে। এখন আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি।’
সত্যি তাই। সমস্ত ঝুঁকির কাজ করবে মাইনে পাওয়া শেরপা-রা, আর কৃতিত্ব নিয়ে যাবে পশ্চিমী অভিযাত্রী বা সংস্থাগুলো, প্রতি বছর দুর্ঘটনায় মরবেও শেরপা-রা — এ আর হতে দিতে নারাজ তারা।
Leave a Reply