দুলাল দাস, কোচবিহার, ২৯ জুন#
নূপুর দাস নাজিরহাট হরকুমারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা পেশায় মাছ ব্যবসায়ী, মা গৃহকর্মী। প্রতিদিনের মতো ২৪ জুন নিজের গ্রাম খুঁটামারা থেকে নাজিরহাটের দিকে রওনা দেয় টিউশন পড়ার জন্য।
পলাশ সেন। বাবা পেশায় কৃষক। মা ও দিদি বাড়িতে সেলাই মেশিনে দরজির কাজ করে। পলাশ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আর পড়াশুনো করেনি। মোবাইল রিপেয়ারিং-এর কাজ করছিল।
সোমবার সকাল ছ-টার দিকে নুপুর যখন খুঁটামারা থেকে নাজিরহাট যাবার আগে পলাশের বাড়ির কাছে বকুলতলায় পৌঁছায়, তখন পলাশ নূপুরের পথ আটকে ধরে। প্রথমে নুপুরের কান কেটে দেয়। পরে পেট ও পাঁজরের সংযোগস্থলে ছুরি বসিয়ে দেয়। সেখানেই সাথে সাথে নূপুরের মৃত্যু হয়। নুপুরের সাথে থাকা আরও দু-জন বান্ধবী ভয়ে কাতর হয়ে নূপুরের বাড়িতে খবর দিতে চলে যায়।
পলাশ সেখান থেকে প্রথমে বাড়ি যায়। তারপর বাড়ির পাশে নার্সারি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পরে জ্যাঠার বাড়ি যায়। সেখানে বমি করে। বমিতে জমিতে ব্যবহারের বিষের গন্ধ বেরোতে থাকে। নুপুরের পরিবার ও প্রতিবেশীরা পড়ে থাকা নূপুরের কাছে এসে পৌঁছায়। পলাশ ইতস্তত ঘোরে। তাকে একটি পুকুরের ধারে বসে থাকতে দেখে ক্ষুব্ধ জনতা তাড়া করলে পলাশ পাটখেতে ঢুকে পড়ে। জনতাও পিছু নেয়। পলাশ দৌড় দিয়ে হরকুমারি স্কুলের দোতলা ঘরের ছাদে উঠে পড়ে। জনতা পাথর ছোঁড়ে। পলাশ নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে। তখন সকাল প্রায় সাতটা। দু-জন যুবক ছাদে উঠে যায়। পলাশ তাদের দেখে নিচে লাফ দেয়। একটি বিকট শব্দ হয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সমস্ত কোলাহল চুপ। কোথাও কোনো শব্দ নেই, পলাশের আর্তনাদ ছাড়া। সকলে বিস্ময়ের সুরে কথা বলতে থাকে। মিনিট পাঁচেক ওভাবেই কাটে। মিনিট পনেরো আগে নাজিরহাট পঞ্চায়েত অফিসে যে পাঁচজন কনস্টেবল থাকে, তার দু-জন এসেছিল। তারা পলাশকে পাহারা দিতে থাকে।
পলাশকে ঘিরে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। তার মধ্যে একজন বলল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। পুলিশ বলল, দিনহাটা থানায় ফোন করা হয়েছে। ওখান থেকে আগে অফিসার আসবে, তারপর যা করার তারাই করবে। সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিটে পলাশ উঠে বসার চেষ্টা করে। আর ভিড়ের মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠল, মরেনি, মার শালাকে। আর সাথে সাথেই বৃষ্টির মতো পাথরের ঢিল পড়তে লাগল। একজন ব্যক্তি একটি পাঁচ কেজি ওজনের পাথর পলাশের বুকের ওপর ছুঁড়ে দিল। কেউ কেউ পলাশের অন্ডকোষে লাথি মারল। দু-জন পুলিশ কোনোরকমে তাদের আটকাতে সমর্থ হল। পলাশের দু-জন বন্ধু পলাশকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তারা জনতার মারে রক্তাক্ত নাক মুখ নিয়ে স্কুলঘরের বারান্দায় বসে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। এরপর আবার দূর থেকে পলাশের কান লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়া শুরু হল। একজন একটা বড়ো বাঁশ এনে পলাশকে খোঁচাতে শুরু করল। পলাশের কানদুটো আর চেনা যাচ্ছিল না। একটা রক্তের দলা। পুরো মুখটাই রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল।
আটটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স এল। জনতা বিক্ষোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে দিল। আবার মারধোর শুরু হল। এরইমধ্যে রোল উঠল, র্যাফ আসছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো মাঠ ফাঁকা। কিছুক্ষণ পরে যখন র্যাফ এল না, জনতা আবার মাঠে ভিড় করল। আবার মারধোর। সাংবাদিকের গাড়ি আসায় জনতা অ্যাম্বুলেন্স ভেবে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পরে সাংবাদিক বুঝে ক্যামেরায় যুতসই ছবি নেওয়ার সুবিধে করে দেয়। ন’টা পঞ্চান্ন নাগাদ র্যাফ এল। মাঠ ফাঁকা হল। একটা নিঃস্তব্ধ মাঠে নিশ্চুপ হয়ে ছেলেটা শুয়ে রইল। প্রাণ ছিল কিনা ঠাওর করা যায়নি। পুলিশ একটি কালো পলিথিনে জড়িয়ে পলাশকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। সংবাদমাধ্যমে খবর হল, পলাশের হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে। \par
পলাশের মা বাবা বোন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। কিছু লোক পলাশের বাড়ি আগুন দিতে আসে। পড়শিদের প্রতিরোধে আগুন না দিয়ে ভাঙচুর করে। বাদ যায় না সংসারের মহিলাদের উপার্জন করার সেলাই মেশিনদুটিও।
কয়েকদিন পেছনে যাই
পলাশ মেয়েটিকে উত্যক্ত করত বলে খবরে প্রকাশ। মেয়েটির পলাশকে পছন্দ ছিল কিনা জানা নেই। পলাশ মেয়েটিকে উত্যক্ত করত এই অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়েটির বাড়িতে পলাশের সালিশি সভা ডাকা হয়। পলাশের পরিবারও উপস্থিত ছিল। সেখানে পলাশকে মারধোর করা হয়। পলাশের বাবাও পলাশকে মারেন বলে শোনা যায়। এটাও শোনা যায় যে, নূপুরকে দিয়ে পলাশকে জুতোপেটা করানো হয়েছিল। কেউ কেউ বলে, দু-তিনদিন আগে নূপুর রাস্তায় পলাশকে জুতো মেরেছিল। আবার অনেকে বলে, খুব ব্যক্তিগতভাবে সালিশি ডাকা হয়েছিল। অনেক পরে সালিশির খবর জানাজানি হয়।
একটি সালিশি প্রসঙ্গ
লিওনার্দো জুনিনের ‘দ্য ফার্স্ট ফোর মিনিট’ বইয়ে আছে, আফ্রিকার কঙ্গো ও জাম্বিয়া এলাকায় বাবেম্বা নামে এক উপজাতিতে কোনো মানুষ যদি কোনো অপরাধ বা অন্যায় করে, তাহলে তাকে গ্রামের একদম মাঝখানে দাঁড় করানো হয়, একা। তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ায় গোটা গ্রাম, সব কাজ ফেলে। তারা একে একে জোর গলায় শোনাতে থাকে, ওই মাঝখানের মানুষটি সারা জীবনে কী কী ভালো কাজ করেছে, কত উপকার করেছে অন্যদের, কত কিছুতে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এই অনুষ্ঠান ততদিন চলে যতদিন না গ্রামের প্রতিটি মানুষের বলা শেষ হয়। শেষে সবাই মাঝখানে থাকা অপরাধীকে ফের কাছে টেনে নেয়। বাবেম্বাদের গ্রামে এই অনুষ্ঠান হয় ৪-৫ বছরে একবার। ওদের মধ্যে অপরাধের হার এইরকমই।
… পলাশ ও নুপুরের মৃত্যুর জন্য কি প্রণয় সম্বন্ধ দায়ী? নাকি আমাদের সালিশি বিচারব্যবস্থার একটুকরো অংশ? সেই সালিশি সভাই কি কুড়ি বছরের একটি ছেলে এবং পনেরো বছরের একটি মেয়েকে তাদের ফুলের মতো জীবন শেষ করে দিতে বাধ্য করল, সেই বিচারব্যবস্থা পলাশকে বাবেম্বাদের মতো অনুতপ্ত করতে পারেনি। বরং দিয়েছিল অনেক অপমান। যদি ওই বিচার বা সালিশিসভা থেকে পলাশ অনুতপ্ত হয়ে ফিরে যেত, তাহলে হয়ত পলাশ ও মেয়েটি সত্যিকারের জীবনের মানে খুঁজে পেলেও পেতে পারত।
Leave a Reply