অমিতাভ চক্রবর্ত্তী,কোচবিহার ,২৫শে জানুয়ারী,২০১৫,তথ্যসুত্রঃ – L. L. Ling et. al., Nature, 2015, DOI: 10.1038/nature14098#
আজকাল প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়াটা আমরা একরকম অভ্যাস করে ফেলেছি। খাবারের ( বিশেষ করে মাংসে) সাথে অজান্তে গ্রহন করা ছাড়াও সামান্য শারিরিক অসুস্থতাতেও আমরা মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক খাই, অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো ডাক্তারের সঠিক পরামর্শ ছাড়াই। এতে শরীরে তৈরী হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক-অনাক্রমতা। শরীরে কোনও বিশেষ প্রকারের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি অনাক্রমতা তৈরী হলে সেই অ্যান্টিবায়োটিক ওই দেহে আর কার্যকরী হবে না। ইংল্যান্ডের এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে কেবলমাত্র এই কারনেই পৃথিবীতে ৩০ কোটির বেশী মানুষের জীবনহানির সম্ভাবনা রয়েছে যদি না খুব শিগগিরি আমরা কোনও পদক্ষেপ গ্রহনে সফল হই। এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের আশঙ্কা। অন্যদিকে এই মুহুর্তে আমাদের হাতে কিন্তু খুব বেশী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (class of antibiotics) নেই। আর আশির দশকের পর থেকে তো নতুন কোনও অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃতই হয় নি। গবেষনা ক্ষেত্রে সাফল্য বলতে তো কেবলমাত্র বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক সেফালোস্ফোরিনের (cephalosporins) নতুন জেনারেশন (জেনারেশন-৫) আবিষ্কার,যা আগেরগুলির চেয়ে আরো বেশী ধরনের ব্যাক্টিরিয়ার জন্যে কার্যকরী অর্থাৎ ব্রডস্পেক্ট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক। তাওতো প্রায় বছর পাঁচেক হতে চলল। এদিকে সীমিত শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিক অপর দিকে চেনা ব্যাক্টিরিয়ার স্ট্রেইন পরিবর্তন করে হঠাৎ অচেনা হয়ে ওঠা, এই দুইয়ের ধাক্কায় ডাক্তার গবেষকদের অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচনে নাজেহাল অবস্থা। কেবলমাত্র অনুমান নির্ভর হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাই ডক্তারবাবুরা কোনও নির্দ্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সেবনমাত্রা বাড়িয়ে দেন। যা আদতে রুগীর জন্যে বিপদই ডেকে আনে।
এই অবস্থায় কিছুটা আশা দেখাচ্ছে সদ্য আবিষ্কৃত এক অ্যান্টিবায়োটিক। নাম টিক্সোব্যাকটিন (teixobactin)। বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’ এর ২০১৫ সালের ৭ই জানুয়ারি সংখ্যায় ৫ পৃষ্ঠা্র মূল গবেষনাপত্রটি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীমহলে প্রবল ভাবে আলোড়ন ফেলেছে। প্রবন্ধটির রচয়িতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, ইংল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের ২১ জন গবেষক। “প্যাথোজেন(রোগ সৃষ্টিকারি)রা যত দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক-অনাক্রমতা তৈরী করছে আমরা সেভাবে অ্যান্টিবায়োটিক খুঁজে পাচ্ছি না” বক্তা এই গবেষকদলের একজন, আমেরিকার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ডিস্কোভারি সেন্টারের কিম লুইস। তার মতে এর অন্যতম প্রধান কারন প্রাকৃতিক অনুজীবিদের(মাটিতে থাকা) মধ্যে কেবলমাত্র ১% পরীক্ষাগারের পাত্রে (petri dishes) বেড়ে ওঠে । বর্তমানে আমাদের হাতে থাকা অ্যান্টিবায়োটিকের একটা বড় অংশই এই অনুজীব থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ৯৯% কে পরীক্ষাগারের পরিবেশে এখনও কালটিভেট করা সম্ভব হয় নি। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধানে এই বাকি ৯৯% এর দিকে আমাদের ভালোভাবে তাকানো দরকার।
এবার দেখি এই গবেষকদল ঠিক কি করেছেন? ওরা এমন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যাতে অনুজীবরা তাদের নিজস্ব পরিবেশে দ্রুত বেড়ে ওঠে। লুইস এবং তার সহকারীরা এদের মধ্যে Elephtheria terrae নামে এক বিশেষ অনুজীব খুঁজে পান যা এই টিক্সোব্যাকটিন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরী করে। এই অ্যান্টিবায়োটিক প্যাথোজেনিক ব্যাক্টিরিয়াদের কোষপর্দা নষ্ট করে তাদের ধ্বংস করে। তবে এই কাজটিও করতে গিয়ে প্রোটিনের পরিবর্তে কোষপর্দার লিপিডকে এটি আক্রমনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়। আর এখানেই এই অ্যান্টিবায়োটিকের সাফল্যের চাবিকাঠি। কারন যে কোনও জীবকোষের ক্ষেত্রেই প্রোটীনের গঠনাকৃতি পরিবর্তন (মিউটেশন) কম আয়াসে হলেও লিপিডের ক্ষেত্রে তা হয় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক-অনাক্রমতার সম্ভাবনা কম। তবে এর কার্যকারিতা এখনো গবেষনাগারের ক্ষুদ্র পরিসরেই আবদ্ধ। জীবদেহে পরীক্ষা করে ওষুধ হিসেবে বাজারে আসতে আরও অনেক পথ পেরোতে হবে। তবে এই গবেষনা একটি বিষয় আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে পরীক্ষাগারে সংশ্লেষণ করে নয়,প্রকৃতি থেকেই খুঁজে বের করতে হবে নতুন নতুন জীবানুসংহারকারী প্রাণদায়ী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক।
Leave a Reply