শিল্পী মৈত্র, কলকাতা, ২৮ আগস্ট#
— একদিন আল্লাহ বান্দাকে ডেকে বলল, ‘দেখ তুই তো রোজ আমার কাছে ফুল চাস। আজ আমার বাগানটাই তোকে দিলাম, কত ফুল নিবি নে।’ বান্দা বাগানে সারাদিন ঘুরল জানো, কিন্তু কোনো ফুলই আর পছন্দ করে উঠতে পারল না। কারণ সবই তো সুন্দর! শেষে সন্ধ্যের আগে বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে হাত বাড়াল, হাতে যে ফুলটা ঠেকল সেটা নিয়েই বান্দা চলে গেল। তারপর আল্লাহ বান্দাকে জিজ্ঞেস করল বুঝলে, ‘আমি তো পুরো বাগানটাই দিলাম, তুমি শুধু ওই ফুলটাই নিলে কেন?’ বান্দা বলল, ‘আমি তো রোজ একটাই ফুল চেয়েছি তোমার কাছে আল্লা, আর সব ফুলই তো সুন্দর কারণ তোমার তৈরি যে।’ প্রেমিকাটি বলল, ‘হ্যাঁ, দেখো, আমাদের জীবনেও তো এমনই হয় বলো। কতজনের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে বিয়ে করতে হয়।’ প্রেমিক বলে, ‘আসলে জানো তো, আল্লাকে ভালবাসলে মানুষকেও ভালবাসতে হয়, মানুষ তো আল্লারই তৈরি বলো।’
গত শনিবার ২৫ আগস্ট সন্ধ্যেবেলা রবীন্দ্র সরোবরে এরকমই একটা কথোপকথন চলছিল আমার পাশে বসা প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে। আরও কিছু কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছিলাম, ওরা আকড়া লাইনের ট্রেন ধরতে চায় আটটার দিকের। হাতে বড়ো জোর আর ১৫ কি ১৮ মিনিট সময় বাকি। দুজন ছাড়াছাড়াই বসেছিল। বয়স দুজনেরই আন্দাজ আঠারো কুড়ির মধ্যে। চেহারা ও কথায় গ্রাম্য ছাপ রয়েছে। হিন্দি ছবি ‘মন’-এর ‘চাহা হ্যায় তুমকো’ গানের ভিডিওটা দুজনে মিলে দেখতে দেখতে কথা বলছিল। আমার ফোন আসায় একটু তফাতে যেতেই একটা জোরালো টর্চের আলোর সঙ্গে এক অদ্ভুত আর্তনাদে ফিরে দেখি, একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বেদম মার মারছে দু-তিনজন লম্বা চেহারার লোক, সেই ছোট্ট চেহারার ছেলেটিকে। প্রেমিকাটি ভয়ে কেঁদে কেঁদে ছেলেটিকে ওদের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘কী হচ্ছে এটা’ জিজ্ঞেস করতেই পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক জানালেন, বোধহয় কিছু করছিল, তাই পুলিশ রেড-এ এসে ওদের ধরেছে। কিন্তু আমি কিছু করতে দেখিনি ওদের। যথেষ্ট ভদ্রভাবেই বসেছিল। একজন ভদ্রমহিলা বললেন, ওরা ওরকম যাকে পারে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে টাকা খাবার জন্য। ‘আরে, আমি তো নিজে দেখেছি ওরা কিছু করেনি।’ বলেই দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এভাবে ওকে মারছেন কেন? কী হয়েছে বলবেন?
ছেলেটি বলতে লাগল, ‘দিদি আপনি তো দেখেছেন, আমরা কিছু অসভ্যতা করছিলাম? বলুন না।’ যারা মারছিল, তাদের মধ্যে থেকে একজন স্থূল চেহারার লোক বললেন, ‘শুনুন ম্যাডাম, পুলিশের কাজে বাধা দেবেন না। আর বেশি কথা বলতে আসবেন না।’ ‘কেন কিছু জানতে চাইব না কেন? আমি প্রত্যক্ষদর্শী। ওরা কিছু অশ্লীল আচরণ করেনি নিজেদের মধ্যে। কেন মারছেন জানতে চাইব না কেন?’ ব্যস, বেধে গেল আমার সঙ্গে তর্কাতর্কি। এদিকে ছেলেটিকে বগলদাবা করে একজন এগিয়ে চলেছে — মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। বারবার মেয়েটি বলছে, ‘আমাদের এভাবে অপমান কোরো না সবার সামনে। আমরা তো কিছু করিনি।’ বগলদাবা করা লোকটি (পুলিশটি) ছেলেটির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কী যেন বলছিল। যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেই পুলিশকর্মীর ভাষা শুনবেন? বললেন, ‘চুপ কর মাগি। তোর জন্য এই ছেলেটা নষ্ট হচ্ছে।’ সরোবরে প্রবেশদ্বারের বাইরে ওদেরকে গাড়িতে তোলার আগে ছেলেটিকে আবার মারতে শুরু করল মাটিতে পেরে ফেলে। মেয়েটি চরম আর্তনাদ করে উঠল।
চোখের আন্দাজে জনা পঞ্চাশেক লোক জমে গেছে। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। ছেলেটির আধমরা অবস্থা। প্রতিবাদের জন্য আমি তখন একা নই। অনেকেই গলা তুলেছেন। ‘আপনারা ওভাবে মারছেন কেন ছেলেটাকে?’ ‘কই সামনের দিকে তো আসেন না, যেখানে অনেকে দৃষ্টিকটুভাবে বসে থাকে?’ ‘যাদের নিয়ে অন্যদের অস্বস্তি হয় তাদেরকে তো কখনো তোলেন না?’ ‘কী ক্রাইম ক্রাইম করছেন, একদিন রেড করে ডিউটি দেখাতে এসে কোন ক্রাইম আটকাবেন আপনারা?”পুলিশ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন যা খুশি তাই করবেন?’ ইত্যাদি। অনেকেই প্রকাশ্যে সোচ্চার হওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না, সঙ্গের বন্ধুর বা বান্ধবীর শাসনে। ‘ডিউটিতে আসা’ পুলিশকর্মীদের অভদ্র আচরণ সাধারণের প্রতি এবং তাদের ‘বেশি কথা বললে, নেতাগিরি দেখালে তোকেও তুলে নিয়ে যাব’ ভঙ্গি আমাদের চেনা টলিউডি গুন্ডা চরিত্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
গুন্ডা দমন শাখা থেকে আসা পরিচয়জ্ঞাপক ব্যক্তি বারবার সেই মেয়েটিকে বলছিল, ‘তুই প্রমাণ কর আগে তুই ওর বৌ, তারপর ওকে ছাড়ব।’
আমার প্রশ্ন, আমাদের ভারতবর্ষে স্বামী স্ত্রীর প্রকাশ্যে অশালীন আচরণ বৈধতা পায়?
অ্যান্টি ক্রাইম অফিসারদের একজন বলেছিলেন যে ‘আমরা চলে যাবার পর একটা কাপল (!) বসতে পারবে না দশ মিনিট। আপনি নিজে ঘুরে দেখে নেবেন। সব ছিনতাই হয়ে যাবে। সব তুলে নেবে। — এই আপনার হাতের মোবাইলটাও থাকবে না।’ আরও বললেন, ‘এই আমরা যদি না আসতাম, হিজরেরা আপনার কাছে দুশো টাকা চাইলে দুশোই দিতে হত। সিকিউরিটির কাছে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আমরা আসি তাই আপনারা এখনও বসতে পারছেন।’
একথা ঠিক, প্রায়শই এমনটা ঘটতে দেখা গেছে। দিনের আলো নিভে আসার আগেই কোনো অশোভনীয় আচরণ সিকিউরিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করালে তারা বিনা বাক্যব্যয়ে তা এড়িয়ে গেছে। সরোবরের ভেতরের চা চানাচুর বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই রেড করতে আসা পুলিশদের দর্শন মেলে বছরের বিশেষ বিশেষ সময়গুলোতেই, মাঝে মাঝে। কোনো উৎসবের আশেপাশের দিনগুলিতে। সবসময় নয়। তিনদিন বাদে সরোবরে সন্ধ্যে সাতটা পনেরোতে একজন হিজরেকে যখন আগের দিনের ঘটনার সময় পুলিশের বলে যাওয়া মন্তব্যটা শোনালাম, উনি বললেন, ‘দেখি তো আমাদের গায়ে কে হাত দেয়। যা থানায় গিয়ে চিঠি লিখে আয়। আমরা প্রতি মাসে পনেরো ষোলো হাজার টাকা দিচ্ছি কি এমনি এমনি। আমাদের একজনকে ধরলে দিল্লি থেকে দশ হাজার জন চলে আসবে।’
রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশকে অপরাধমুক্ত করতে আসা জনা সাতেকের দলটির আচরণে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হল, ১) আকড়া-সন্তোষপুরের মেয়েরা মেয়েছেলে, মাগি, আর শহরের মেয়েরা মেয়ে, ম্যাডাম। ২) ওঁরা যদি এত কিছুই জানেন, কখন কোন ঘটনা এখানে ঘটে বা ঘটতে পারে, কারা কী করে থাকে এবং অন্যান্য, তবে শুধুমাত্র সন্ধ্যে সাতটার সময় এসে কোন অপরাধটা নির্মূল করবেন? ৩) যদি দিনের আলো থাকতে প্রকাশ্যে কোনো মেয়ের হাত ধরে কেউ টানে বা কোনো ছিনতাই হয়, তবে সন্ধ্যে সাতটায় এসে কি সেটা আটকানো সম্ভব? এধরনের জনসমাগমের স্থানে কোনো জোরালো সিকিউরিটির ব্যবস্থা নেই কেন? শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের দিনগুলোতেই কি অপরাধ ও অপরাধ দমনের প্রচেষ্টা চলবে? বছরের অন্যান্য দিনগুলো নিরাপদ?
সেই অভিযুক্ত-নির্দোষ-ভীত-অপমানিত প্রেমিক প্রেমিকাকে লেক থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন ২৬ আগস্ট রবিবার লেক থানার ওসি শ্রী পি এস মুখার্জির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওদের দুজনকে ষাট সত্তর টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ঘটনার দিনই। অভিযুক্ত প্রেমিক-প্রেমিকা নাম ঠিকানা জানাতে থানা অস্বীকার করে।
সংযোজনী : এই ধরনের পরিস্থিতির সমাধান কি আমি জানি না। পাঠকদের যাদের এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা চাই — শিল্পী।
Leave a Reply