তপন দত্ত স্মরণসভা
কোনো কোনো মৃত্যু পাথরের চেয়ে ভারি, সেই ভার বহন করার দায় তাদের, যারা নিজেদের ব্যক্তিজীবনের গণ্ডির বাইরে চারপাশটা তাকিয়ে দেখে, ভাবে কীভাবে সকলকে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচা যায়, কীভাবে আমাদের চারপাশটা বাসযোগ্য রাখা যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। ২০১১ সালের ৬ মে তপন দত্ত ঘাতকদের হাতে খুন হয়ে গেলেন। যারা আসল খুনি, কয়েকটি কর্পোরেট হাউস, তারা দিব্যি জয়পুর বিলটাকে ভরাট করে সেই ভরাট করা অংশে ঘটা করে হোসিয়ারি পার্কের উদ্বোধন করে, মন্ত্রীকে ডেকে আনে। আর সেই মন্ত্রী যে মন্ত্রীসভাকে অলংকৃত করেন তার মুখ্যমন্ত্রী খুব সুন্দর বাণী বিতরণ করেন, জল ভরো, জল ধরো। কোনটা যে মুখ আর কোনটা যে মুখোশ তা আমরা ধরতে পারি না। আমরা শুধু পারি মিটিং-মিছিল-পোস্টার মারফত আমাদের প্রতিবাদী কন্ঠকে তুলে ধরতে আর মহামান্য বিচারালয়ের কাছে এদেশের সরকারের তৈরি আইন যাতে কার্যকর হয় তার আবেদন জানাতে। তপন দত্তও আবেদন করেছিলেন মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের গ্রীণবেঞ্চে জয়পুর বিল ভরাটের বিরুদ্ধে। বিচারকের স্হগিতাদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কর্পোরেট-সিন্ডিকেট চক্র ভরাট অব্যাহত রেখেছিল। এবারে মহামান্য বিচারক একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির হাতে জলাভূমিগুলি সম্পর্কে মতামত দেবার দায়িত্ব দিয়েছেন। কমিটির সদস্যরা ইতিমধ্যে ভরাট হওয়া জয়পুর বিল ও হিন্দমোটরের বিপন্ন জলাভূমিটি পরিদর্শন করে গেছেন, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, নিচের থেকে জনমত তৈরি না হলে, আন্দোলন প্রচার সংগঠিত করতে না পারলে বিচারালয়ের কোনো রায় বা নির্দেশ কার্যকর হয় না। তপন দত্ত স্মরণে অনুষ্ঠান করার পেছনে উদ্যোক্তাদের এই উদ্দেশ্যটা কাজ করেছিল।
গত ৫ ও ৬ মে, ২০১২ তপন দত্তের নিজের হাতে গড়া সংগঠন সিটিজেন রাইটস অ্যান্ড প্রোটেকশন ফোরাম এবং এপিডিআর (বালি শাখা)-র যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় কুমিল্লা পাড়ার মাঠে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ৫ মে সকাল দশটায় বালি, ঘোষপাড়ার লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে যেখানে তপন দত্তকে খুন করা হয়েছিল সেই স্থানে শহিদ বেদীতে মাল্যদান এবং সেখান থেকে মিছিল করে কুমিল্লা পাড়ার মাঠে আসার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। উদ্যোক্তারা তপন দত্তের ছবি সহ সুন্দর করে একটা মঞ্চ বানিয়েছিলেন। মঞ্চের পেছনের পর্দায় ছিল জয়পুর বিল ভরাটের একটা বিশাল ছবি। প্রথম দিনের সকালে ছিল ছাত্রছাত্রীদের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, বিষয় জলাভূমি ও পরিবেশ। পাশাপাশি ছিল বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা। তপন দত্তের বিধবা স্ত্রী প্রতিমা দত্ত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। বিকেলের আলোচনা সভায় ঊদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বাবন গাঙ্গুলি, সুব্রত গাঙ্গুলি,জয়ন্ত সরকার, কুনাল ঠাকুর, অচ্যুত সেনগুপ্ত প্রমুখ বক্তারা জলাভূমি ও পরিবেশের ওপর বক্তব্য রাখেন। সভার শেষে প্রায় শতাধিক দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে ব্যাগ ও পেন্সিল বাক্স দেওয়া হয়। ৬ মে সকালের কর্মসূচি ছিল রক্তদান শিবির। বিকেলের আলোচনা সভায় ঊপস্থিত ছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র, মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব সুজাত ভদ্র এবং অশোকেন্দু সেনগুপ্ত। বক্তারা তাঁদের নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে জলাভূমির প্রয়োজনীয়তা, বিশেষভাবে জয়পুর বিলের গুরুত্ব সম্পর্কে কল্যাণ রুদ্র মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। কবির সুমন ঊপস্থিত থাকতে না পারলেও অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেন। এছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সভায় উদ্যোক্তা সংগঠনের সভাপতি বিবেকানন্দ ভট্টাচার্য এবং গণ উদ্যোগের পক্ষে সুব্রত হালদার ও অন্যান্য সংগঠনের পক্ষে কুনাল গুহরায়, শংকর হাজরা প্রমুখ বক্তা খুব যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন।
অরুণ পাল, বালি, ৩০ মে
Leave a Reply