বিনোদ, অংশু, শ্যামলীদের সাথে কথা হল, সংলগ্ন মজদুর কলোনির বস্তি উচ্ছেদ সম্পর্কে। — আমরা তো এখানে পাঁচ বছরের ওপরে আছি। কিছু ঘর বসেছে বছর দেড়েক, বাকিরা তো এই কয়েক মাস হল এসে বসেছে। যখন বসছিল তখন আমরা বলেছিলাম, এই জায়গাগুলো অনেক আগেই মাপজোখ হয়ে গেছে। আমাদের জায়গাটাও। তখন টাটা সুমো করে বড়ো অফিসাররা এসে জায়গা মেপে খোটা পুঁতে গেছিল। আমরা বলেছিলাম, ওসব চ্যাংড়া ছোকরাদেরকে টাকা দিয়ে এখানে ওভাবে বোসো না। ওরা বলেছিল, দেখি যদি আমাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। এখন যাদের টাকা দিয়েছিল, তাদের ডাকুক, ডেকে তাদের বলুক। এখন মুখে বলছে টাকা দেয়নি।
কথা বলার সময় পাশ থেকে এক অল্পবয়সি ছেলে বলে উঠল, আমরা আসা যাওয়ার পথে শুনতে পেতাম, ‘এখান থেকে মেপে নে, ১০ হাজার লাগবে, ১৫ হাজার লাগবে’। একেক দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আটটা দশটা করে ঘর উঠছে। ওভাবে মাঠের মাঝখানে কেউ বসে, লোকের চোখে লাগবে না। এই তো ক’মাস হল ওরা ওখানে বসছে। আমরা যেখানে ওদের সাতে-পাঁচে নেই। আপনারা জানেন, ওই পাশের বস্তিতে যখন সেদিন (উচ্ছেদের দিন) আগুন লাগল তখন তার কিছু পরে দেখি, একজন লোক বুড়ো মতন, আমাদের দিকে এসে আগুন নিয়ে কী করছে। জিজ্ঞেস করতে বলল বিড়ি ধরাচ্ছি। তারপর তাকে ধরে সরিয়ে দেওয়া হল।
‘আপনারা আগে দেখেছেন আমাদের, কত কষ্ট করে থেকেছি’ — শ্যামলীর কথায় উঠে আসল পাঁচ বছর আগের স্মৃতি। খাল পার থেকে উচ্ছেদ হয়ে, অন্যান্যদের মতো ফ্ল্যাট না পেয়েও, জীবনের কাছে হার না মেনে কীভাবে সেদিন এই ঝিলের পারে সাপ-খোপের জঙ্গল কেটে ঘর বানিয়ে বাস করতে শুরু করেছিলেন — ‘ঘর বাঁধার সাথে সাথেই এক জোড়া সাপ এসে ঘরে ঢুকে ছিল। তখন পাশেই আমি মা মনসাকে পূজা দিয়ে মনসার থান তৈরি করলাম। এখন বয়স বেড়েছে, আগের মতো আর কাজ করতে পারি না। সেদিনের আমি যখন এখানে এসেছিলাম আমাদের পাশে কেউ ছিল না। আমার মতো যারা খাল পার থেকে উচ্ছেদ হলাম, তারা কয়েকজন এসে এই ঝিলের পারে জায়গাটায় ঘর বাঁধলাম।
— আমাদের পেটে বিদ্যে নেই, আইনকানুন জানি না তাই ওদের কথা বুঝতে পারি না। গরিবের কে আছে বলুন? এই এখানে থাকার জন্য কম ঝামেলা পোহাতে হয়েছে? ওই যে ফ্ল্যাটের পাশে স্কুল, ওখানের কলে জল আনতে গেলে কলের ডান্ডা খুলে রেখে দেয় আগে। মাঝেমধ্যেই হুমকি শুনি। এই আমি বিধবা অনেক দিন ধরে আছি। শুনেছি সরকারের কীসব ভাতাটাতা আছে, তার কিছু কি পাই? আগে তো আমাদের রেশন কার্ডও ছিল না। এখন ২৫% রেশন কার্ড হয়েছে। আর ৭৫% ভোটার কার্ড। এই এতদিন পরে আধার কার্ডের জন্য ছবি দিয়ে ফর্ম জমা দিলাম সবার জন্য। গরিবের কে আছে বলুন? আমাদের না দিলে কি ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা আছে? এই যে আপনারা ওদের জন্য এত লড়ছেন কিছু আদায় করতে পারলেন? সবাইকে ফার্স্ট হতে হবে। মার খাওয়াতে, জেলে ঢুকতেও ফার্স্ট। আপনারা যদি কিছু আদায় করতে পারতেন তা হলে আমরাও যেতাম আপনাদের সঙ্গে।
আমাদের তো কোনো কিছুই ছিল না তা তো আপনারা জানেন। জল লাইট কিছুই তো ছিল না। মশাতে সন্ধ্যের পর বসা যেত না, সেতো আপনারা আগে এসে দেখেছেন। এখানে বসার পর পাশের ভেড়ির মৎস্যজীবীরা অনেক সাহায্য করেছে এখানে থাকতে। অনেক হাতে পায়ে ধরে এখানে জল আর লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের সকলের মিলে ৫ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছে এই লাইট আনতে। আর জলের কল বসিয়েছে কাউন্সিলার। সিপিএম তৃণমূল দু’জনেই সাহায্য করেছে।
পাশে দাঁড়িয়ে একজন বললেন, তবে এখন কাউন্সিলারের কাছে কেউ আমরা সইয়ের জন্য গেলে আজ না কাল বলে বড্ড ঘোরায়। আজ এই তো কাল সেই। এই আমি আমার হাত পুড়ে যাওয়াতে গেছিলাম, হসপিটালের ফ্রি চিকিৎসার জন্য। তিন দিন ঘুরলাম, পরে একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসা করলাম।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনেই লেকপল্লির উল্টোদিকের কয়েকটি ঝুপড়ি দোকান ভাঙা পড়ল। বস্তির রাস্তার পাশেই বিশ্বজিৎ-এর চায়ের দোকান ছিল। খুব ভালো চা বানাত বিশ্বজিৎ। সেটা ভাঙা পড়ল।
‘আপনাদের লেকপল্লির পাঁচটা ঘর তো ওপারে ছিল, সেটাও তো ভাঙা পড়ল?’ প্রশ্নের উত্তরে শ্যামলীদি বললেন, ‘কী করব, পাঁচ জনের কথা ভাবব, না পল্লির দুশো জনের কথা ভাবব? দেখা যাক ওরা পাশে ঘর বাঁধতে পারে কিনা!’
‘শুনলাম আপনাদের বস্তি থেকে কাল যে টিএমসি-র মিছিল হয়েছিল, তাতে অনেকে গেছিল?’ এক মহিলা পাশ থেকে বলে উঠলেন, পাড়ার লোক মিছিলে ডাকলে যাব না! ওই ফ্ল্যাটের লোক এসে কথা শুনাচ্ছিল, কী কাল মিছিলে গেলে আজ তোমাদের দোকান ভেঙে দিল? যাব না তো কী করব! আমাদের কি কোনো উপায় আছে। বলে ভাঙা দোকানের চালা সরাতে চলে গেলেন। শ্যামলীদি দোকানটা মনসা থানের পাশে লাগাতে বললেন।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক বলে উঠলেন, যদিও পাশের ভেড়ি কোনোদিন বোজানো হয় তাহলে হয়তো আমাদেরও এখান থেকে উঠে যেতে হবে। নিজের জালে গলায় দড়ি দাও, পরের জালে ঘর বানাতে নেই। ওরা আমাদেরকে জলে টেনে নিয়ে যাবে, জল কমলে বলবে পালাও পালাও। এক হয়ে কী হবে? কিছু করার ক্ষমতা আছে আমাদের? এই তো আপনারা এত করছেন কিছু করতে পারছেন? গরিবের জন্য কেউ নেই। ওখানে যাদের আছে তাদের বাদ দিয়ে যাদের কিছু নেই তাদের খুঁজে বার করে তাদের বসার জায়গা করে দিক না। বলতেই তো পারে, এখানে এত কষ্ট করিস নে বাবা, আপাতত ওইখানে বস, যখন লাগবে তখন কিন্তু ছেড়ে দিতে হবে বাবা। ওই ফ্ল্যাটগুলোতে তো অনেকের আত্মীয়রা খালি পেয়ে বসে গেছে, যাদের ওখানে ফ্ল্যাট আছে।
কথা বলার সময় পাশ থেকে এক অল্পবয়সি ছেলে বলে উঠল, আমরা আসা যাওয়ার পথে শুনতে পেতাম, ‘এখান থেকে মেপে নে, ১০ হাজার লাগবে, ১৫ হাজার লাগবে’। একেক দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আটটা দশটা করে ঘর উঠছে। ওভাবে মাঠের মাঝখানে কেউ বসে, লোকের চোখে লাগবে না। এই তো ক’মাস হল ওরা ওখানে বসছে। আমরা যেখানে ওদের সাতে-পাঁচে নেই। আপনারা জানেন, ওই পাশের বস্তিতে যখন সেদিন (উচ্ছেদের দিন) আগুন লাগল তখন তার কিছু পরে দেখি, একজন লোক বুড়ো মতন, আমাদের দিকে এসে আগুন নিয়ে কী করছে। জিজ্ঞেস করতে বলল বিড়ি ধরাচ্ছি। তারপর তাকে ধরে সরিয়ে দেওয়া হল।
‘আপনারা আগে দেখেছেন আমাদের, কত কষ্ট করে থেকেছি’ — শ্যামলীর কথায় উঠে আসল পাঁচ বছর আগের স্মৃতি। খাল পার থেকে উচ্ছেদ হয়ে, অন্যান্যদের মতো ফ্ল্যাট না পেয়েও, জীবনের কাছে হার না মেনে কীভাবে সেদিন এই ঝিলের পারে সাপ-খোপের জঙ্গল কেটে ঘর বানিয়ে বাস করতে শুরু করেছিলেন — ‘ঘর বাঁধার সাথে সাথেই এক জোড়া সাপ এসে ঘরে ঢুকে ছিল। তখন পাশেই আমি মা মনসাকে পূজা দিয়ে মনসার থান তৈরি করলাম। এখন বয়স বেড়েছে, আগের মতো আর কাজ করতে পারি না। সেদিনের আমি যখন এখানে এসেছিলাম আমাদের পাশে কেউ ছিল না। আমার মতো যারা খাল পার থেকে উচ্ছেদ হলাম, তারা কয়েকজন এসে এই ঝিলের পারে জায়গাটায় ঘর বাঁধলাম।
— আমাদের পেটে বিদ্যে নেই, আইনকানুন জানি না তাই ওদের কথা বুঝতে পারি না। গরিবের কে আছে বলুন? এই এখানে থাকার জন্য কম ঝামেলা পোহাতে হয়েছে? ওই যে ফ্ল্যাটের পাশে স্কুল, ওখানের কলে জল আনতে গেলে কলের ডান্ডা খুলে রেখে দেয় আগে। মাঝেমধ্যেই হুমকি শুনি। এই আমি বিধবা অনেক দিন ধরে আছি। শুনেছি সরকারের কীসব ভাতাটাতা আছে, তার কিছু কি পাই? আগে তো আমাদের রেশন কার্ডও ছিল না। এখন ২৫% রেশন কার্ড হয়েছে। আর ৭৫% ভোটার কার্ড। এই এতদিন পরে আধার কার্ডের জন্য ছবি দিয়ে ফর্ম জমা দিলাম সবার জন্য। গরিবের কে আছে বলুন? আমাদের না দিলে কি ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা আছে? এই যে আপনারা ওদের জন্য এত লড়ছেন কিছু আদায় করতে পারলেন? সবাইকে ফার্স্ট হতে হবে। মার খাওয়াতে, জেলে ঢুকতেও ফার্স্ট। আপনারা যদি কিছু আদায় করতে পারতেন তা হলে আমরাও যেতাম আপনাদের সঙ্গে।
আমাদের তো কোনো কিছুই ছিল না তা তো আপনারা জানেন। জল লাইট কিছুই তো ছিল না। মশাতে সন্ধ্যের পর বসা যেত না, সেতো আপনারা আগে এসে দেখেছেন। এখানে বসার পর পাশের ভেড়ির মৎস্যজীবীরা অনেক সাহায্য করেছে এখানে থাকতে। অনেক হাতে পায়ে ধরে এখানে জল আর লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের সকলের মিলে ৫ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছে এই লাইট আনতে। আর জলের কল বসিয়েছে কাউন্সিলার। সিপিএম তৃণমূল দু’জনেই সাহায্য করেছে।
পাশে দাঁড়িয়ে একজন বললেন, তবে এখন কাউন্সিলারের কাছে কেউ আমরা সইয়ের জন্য গেলে আজ না কাল বলে বড্ড ঘোরায়। আজ এই তো কাল সেই। এই আমি আমার হাত পুড়ে যাওয়াতে গেছিলাম, হসপিটালের ফ্রি চিকিৎসার জন্য। তিন দিন ঘুরলাম, পরে একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসা করলাম।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনেই লেকপল্লির উল্টোদিকের কয়েকটি ঝুপড়ি দোকান ভাঙা পড়ল। বস্তির রাস্তার পাশেই বিশ্বজিৎ-এর চায়ের দোকান ছিল। খুব ভালো চা বানাত বিশ্বজিৎ। সেটা ভাঙা পড়ল।
‘আপনাদের লেকপল্লির পাঁচটা ঘর তো ওপারে ছিল, সেটাও তো ভাঙা পড়ল?’ প্রশ্নের উত্তরে শ্যামলীদি বললেন, ‘কী করব, পাঁচ জনের কথা ভাবব, না পল্লির দুশো জনের কথা ভাবব? দেখা যাক ওরা পাশে ঘর বাঁধতে পারে কিনা!’
‘শুনলাম আপনাদের বস্তি থেকে কাল যে টিএমসি-র মিছিল হয়েছিল, তাতে অনেকে গেছিল?’ এক মহিলা পাশ থেকে বলে উঠলেন, পাড়ার লোক মিছিলে ডাকলে যাব না! ওই ফ্ল্যাটের লোক এসে কথা শুনাচ্ছিল, কী কাল মিছিলে গেলে আজ তোমাদের দোকান ভেঙে দিল? যাব না তো কী করব! আমাদের কি কোনো উপায় আছে। বলে ভাঙা দোকানের চালা সরাতে চলে গেলেন। শ্যামলীদি দোকানটা মনসা থানের পাশে লাগাতে বললেন।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক বলে উঠলেন, যদিও পাশের ভেড়ি কোনোদিন বোজানো হয় তাহলে হয়তো আমাদেরও এখান থেকে উঠে যেতে হবে। নিজের জালে গলায় দড়ি দাও, পরের জালে ঘর বানাতে নেই। ওরা আমাদেরকে জলে টেনে নিয়ে যাবে, জল কমলে বলবে পালাও পালাও। এক হয়ে কী হবে? কিছু করার ক্ষমতা আছে আমাদের? এই তো আপনারা এত করছেন কিছু করতে পারছেন? গরিবের জন্য কেউ নেই। ওখানে যাদের আছে তাদের বাদ দিয়ে যাদের কিছু নেই তাদের খুঁজে বার করে তাদের বসার জায়গা করে দিক না। বলতেই তো পারে, এখানে এত কষ্ট করিস নে বাবা, আপাতত ওইখানে বস, যখন লাগবে তখন কিন্তু ছেড়ে দিতে হবে বাবা। ওই ফ্ল্যাটগুলোতে তো অনেকের আত্মীয়রা খালি পেয়ে বসে গেছে, যাদের ওখানে ফ্ল্যাট আছে।
শ্রীমান চক্রবর্তী, লেকপল্লি নোনাডাঙা, ৬ ও ১৪ এপ্রিল। শ্যামলীর ছবি শমীক সরকারের তোলা
Leave a Reply