অমিতাভ সেন, কলকাতা, ২৪ মে#
নার্সিং হোমের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে শুয়ে আছি। অপারেশনের পরে আজ তিনদিন হল। নড়াচড়া করতে পারছি না। শরীরে তিনটে ঢোকার পাইপ — রক্ত, স্যালাইন, অক্সিজেন। দুটো বেরোনোর পাইপ — পেচ্ছাপ ও রক্তরস। যন্ত্রণা ও উদ্বেগে ঘুমোতেও পারছি না। নিজের ওপর নিজের নজরদারী টিঁকিয়ে রাখতে হচ্ছে। গতকাল রাতে ডাক্তারবাবু বলে গেলেও সকালের সিস্টার ব্লাড দিতে ভুলে গেছিলেন অথবা তাঁকে ঠিকমতো খবর দেননি রাতের দায়িত্বে থাকা নার্স। এরকমভাবেই আরেকটা ইনজেকশনের কথা মনে করিয়ে দিতে হল সকালের বালিকা নার্সকে।
বালিকা নার্স মানে এখানকার ট্রেনি-সিস্টার। উনিশ-কুড়ি বছরের চারটে মেয়ে দু-বেলা পালা করে আসে নীলস্কার্ট সাদাশার্ট সাদা কেডস-মোজা পরে ট্রেনি-নার্সের ডিউটি করতে। সুনীতা, আয়েষা, মল্লিকা, শ্যামলী। একজনের বাড়ি ক্যানিং, একজনের গঙ্গাসাগর, একজনের দক্ষিণ বারাসাত, একজনের মথুরাপুর। সবাই দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার চাষি ঘরের মেয়ে — গল্প করে তাই জানা গেল। চারজনেরই গ্রামীণ সজীবতা এখনও শুকিয়ে যায়নি — আয়েষা রাতের ডিউটিতে এসে উপরের ক্যান্টিন থেকে খবর নিয়ে সামনের করিডোর দিয়ে যেতে যেতেই একটু উল্লাস করে ফেলে ‘ডিম হবে’ বলে, সুনীতা কাজে ভুল করে সিস্টার দিদির কাছে বকা খেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে এসে দাঁড়ায় আমার কাছে, বলে, ‘আমি কি তোমায় জোর করেছি পাশ ফেরাতে বলো’, আমি ‘না না’ বলে সান্ত্বনা দিই, বলি ‘আমার ব্যথারই দোষ’, মল্লিকা আয়ামাসির সঙ্গে ঝগড়া করে আমার সামনেই, ‘দ্যাখো মাসি, মাসি আছো মাসির মতো থাকবে, আমি যদি রুগির সঙ্গে কাজ আছে বলে তোমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলি’ এই পর্যন্ত শুনেই সন্ধ্যামাসি রেগে বেরিয়ে যায়; শ্যামলী বেশ জোরে হাসলে বয়স্ক সিস্টার দিদি বলেন, ‘ওরে তোর ওই বয়সে আমিও হাসতাম, আমার বয়সে এলে তোকে কাঁদতে হবে’, শুনে শ্যামলী আরও জোরে হাসে।
আমি ওদের সব সময় দেখতে পাই না, কিন্তু ওদের উপস্থিতি টের পাই। প্রায় আমার মেয়ের বয়সি এই মেয়েগুলোর জন্যই যেন সেরে উঠতে পারছি। এরা শুধু আমাকে নয়, সকলকেই খুব মন দিয়ে সেবা করে। যদিও মাইনে পায় ২৩০০ টাকা। তার থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৩০০ টাকা কেটে নিলে হাতে আসে ২০০০ টাকা। আর, এদের বাড়ি দূরে বলে, নার্সিংহোমের একটা ঘরে এই মেয়েদের শোওয়ার জায়গা দেওয়া হয়, আর তিনবেলার খাওয়া বিনি পয়সায়। এরা ছুটি পায় দু-সপ্তাহ পরে ২/১ দিনের জন্য।
ভোটের দু-দিন নার্সিংহোমে খুব ঝামেলা লেগে গেল। সবাই ভোট দিতে যাবে — যাদের বাড়ি দূরে তাদের ১ দিন ছুটিতো লাগবেই। নার্স-আয়া-স্টাফদের সংখ্যা খুব কম। যারা আছে তাদের সকলকে ২৪ ঘন্টা, ৩৬ ঘন্টা করে ডিউটি দিতে হচ্ছে। আমি আগের থেকে একটু সুস্থ হলেও — একা একা শুধু বিছানায় উঠতে বসতে পারি, আর কিছু পারি না। নিজের পা চুলকাতে হলেও লোক ডাকতে হবে মনে হয় — সে এক করুণ অবস্থা। তার মধ্যেই দেখি উল্টোদিকে ৩ নং আই.সি.ইউ.-এর রুগির ঘরে তিনজন নান এসে বই খুলে (সম্ভবত বাইবেল) কীসব ইংরাজীতে পাঠ করছে। আগের দিনই শুনেছি এই বৃদ্ধ রুগির পদবি ডিসুজা; নার্সদের গল্পে জানা যায় উনি বড়ো ব্যবসায়ী, এবং ইংরাজীতে কথা বলেন ওঁদের আত্মীয়রা, ওঁরা খ্রীস্টান। সেই জন্য কিনা জানিনা ওই রুগির আত্মীয়স্বজন ভিজিটিং আওয়ার্সের পরে যখন তখন আসে এবং আই.সি.ইউ.তে সন্ধ্যের পরে এক সাদা মোজা পরা পাদরি ঢুকে পড়েন — আমি দেখি তিনি পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে, বাক্স থেকে কাঁচের টুকরোর মতো চকচকে একটা জিনিস রুগির পেটের উপর রেখে, পকেট থেকে নোটবই বার করে সেখান থেকে কী পাঠ করেন বিড় বিড় করে — একে বোধহয় খ্রীস্টান মতে তুকতাক বলা যায়।
যাই হোক নার্স বালিকাদের একজন এসে অনুযোগ করে, ‘ওই খ্রীস্টান দাদু ভালো না, খুব মুখ করে, আমাকে বলছিল, ‘তোমাদের সবাইকে দেখতে একরকম’,(অর্থাৎ সবাই খুব কালো)’। ওই ভদ্রলোকের বদমেজাজের প্রকাশ অবশ্য এঘর থেকেই ওনার চেঁচামাচিতে আমি টের পাচ্ছি।
১ নং-এ গত রাতে যে পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে সে একটা কমবয়সি ছেলে। একজন নার্সিংস্টাফ আমাকে বলছিল ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। বাবার অবস্থা খুব ভালো না, চার ছেলে মেয়ের মধ্যে এই ছেলেটাকেই পয়সাখরচ করে পড়াতে পেরেছেন, এখন ছেলেটা বন্ধুদের সঙ্গে ছাঁইপাঁশ গিলে এমন নেশা করেছিল যে জ্ঞান ফিরছিল না। আজ জ্ঞান ফিরেছে। গতকাল ওর মা ওর বাবার সঙ্গে ছেলেকে দেখতে এসে কাঁদছিল। ‘এইসব ছেলেকে কী বলবেন? এরা নাকি ব্রিলিয়ান্ট? এদেরকে কী করা উচিত? — ক্ষুব্ধ স্টাফনার্স আমাকে তিনটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গটমট করে আমার রুমের বাইরে যেতেই সিস্টার বন্দনাদি তাকে পাকড়াও করে, ‘অনিমা, কাল আমি আধঘন্টা লেটে এসেছিলাম সেটা তুমি বাবুদাকে লাগিয়েছো, আজ যে আমি একঘন্টা বেশি আছি, এটাও লাগিও।’ অনিমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘যদিও আমি লাগাইনি, কাল যে লেটে এসেছিলেন সেটা কি ভুল’? এর উত্তরে বন্দনাদি কী বললেন শোনা গেল না।
mitra chatterjee says
anyo rokom..rugi nije i erokom kom i likhe thaken ..sahoj sarol dekha