অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৪ মে#
১
জেলখানার সঙ্গে প্রথম মিল — কয়েদিদের মতো রোগীদের নাম নেই, আমার নাম ৪ নম্বরের পেশেন্ট। আয়ামাসি — অন্য স্টাফ — সব্বাই এই নামেই ডাকে। আরেকটা মিল — জেলের সেলের মতো এই যে ঘরে আছি তার একটাই দরজা — বাকি সব জানলা-দরজা বন্ধ থাকায় কোথাও দিয়ে আলো-হাওয়া ঢোকে না, অবশ্য একটা বড়ো অমিলও আছে — জেলখানায় এয়ার কন্ডিশনিং মেশিন নেই, এখানে আছে। তিন নম্বর মিল — কড়া নিষেধ ও পাহারা — আমি ডানদিকের বাথরুমে ও বাঁদিকের মুখ ধোওয়ার বেসিনে যেতে পারি এই ঘরের বাইরের বারন্দায় ৪-৫ ফুটের মধ্যে — তার বেশি নয় — গেটের দিকে আর দু’পা গেলেই নার্সের বকা, সিকিউরিটির ধমক — আমার যে এখনও কিছু অপারেশন টানাপোড়েন হয়নি কেউ শুনবে না; শুশ্রূষার রকমটাই হচ্ছে — রোগীর কথা কেউ শুনবে না — রোগী সবার কথা শুনবে। এটাই দস্তুর — সব রোগীকেই বেয়াড়া ধরে নিতে হবে নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য।
আমার ডাক্তারবাবু খুব বড়ো ডাক্তার — তাঁর যখন সময় হবে তখন আসবেন — তাঁর প্রচণ্ড ব্যস্ততা — আমাকে তাই আগে থেকে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছে এই নার্সিংহোমখানায়। শুধুশুধু একটা বাড়তি দিন এখানে আটকা পড়ে থাকায় মনটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। আত্মীয়-বন্ধুরা যারা আমার এই অসুখ ও অপারেশন নিয়ে ব্যস্তসমস্ত তাদেরকে কি আর ওই ক্ষোভের কথা বলা যায় — এমনিতেই আমাকে নিয়ে তাদেরকে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে দেখে আমি যথেষ্ট কুণ্ঠিত।
অবশ্য একটা দিন কেটেও গেল — গল্পের বই পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিলাম বেশি সময়টা। তারই মাঝে ১ নং বেডের পেশেন্ট জড়ানো গলায় মাসিদেরকে বুঝিয়েছে যে উপস্থিত তরুণী নার্সের (যে তাঁর ব্লাড পেশার মাপছিল) একটা দেখেশুনে ভালো বিয়ে দেওয়া দরকার — সেই থেকে উঠে গেছে বিয়ের কথা। এই ঘরে চারজন পেশেন্টের চারজন মাসি — তাদের মতে : দেখে শুনেই বিয়ে দেওয়া দরকার। আজকালকার ছেলে মেয়েরা ভালোবাসা করে, মোবাইলে মোবাইলে কথা বলেই বিয়ে করে বসে এবং তারপরই ডিভোর্স করে। মাসিদের সময়ে এরকম ছিল না (বেশিরভাগ মাসির বয়স পঞ্চাশের উপরে) — ওদের ১২/১৩ বছরে বিয়ে হয়েছে, তখন বিয়ের রেজিস্ট্রিও ছিল না; তাতে ছেলে-মেয়েরা ভালো থাকে। বিশেষ করে মেয়েদের নজর রাখা দরকার মেয়েদের উপর — তারা বাড়ি ফিরতে দেরি করে কেন, কলেজের নাম করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। ৩ নম্বরের মাসি তাকে সমর্থন করে বলে, ঠিকই বলেছো, মায়েরা বাচ্চাদের ছেড়ে গেলে বাচ্চা থাকতে পারে? বাবারা পারে না বাচ্চা মানুষ করতে। কিন্তু বাবারা ছেড়ে চলে গেলেও মায়েরা একা সাতটা বাচ্চাও মানুষ করতে পারে।
২ নম্বরের পেশেন্ট গোঙাছিলেন — তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ — মাসি জিজ্ঞেস করায় জানা গেল, তিনি ড্রাইভার, গাড়ির স্টিয়ারিং কেটে যাওয়ায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাঁকে চামচে করে খাইয়ে দিতে হল। ১ নম্বরের পেশেন্ট পুলিশে কাজ করেন, সেরিব্রাল অ্যাটাকে ভর্তি — তাঁর বিশ্বাস পেশারের ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়ায় অমনটা হল। তিনি তাঁর অচল ডানহাত ও ডানপা সচল করতে খুবই চেষ্টা করছেন; আর ডাক্তারবাবুকে বলছেন তাঁর সব ঠিক হয়ে গেছে, তাঁকে ছেড়ে দিতে। ডাক্তারবাবু বলছেন তাঁর সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট ভালো আসেনি। কিন্তু রোগী জিজ্ঞেস করছেন, বাড়ি গিয়ে মোটরবাইক চালাতে পারবেন কিনা। ডাক্তার বললেন রোগীকে সার্কাসে পাঠিয়ে দেবেন। আয়ামাসিরা জোর হেসে উঠল।
৩ নম্বরের পেশেন্ট খুব চীৎকার চেঁচামেচি করলেন কাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত — তাঁর খুব কষ্ট, পেচ্ছাপ হচ্ছে না। ক্যাথিটার পাল্টানো হল দুবার, তাঁর বাড়ির লোক সব ভিতরে চলে এল, যখন পেশেন্ট পার্টির আসার কথা নয়। রাত নটার পরে রোগী সুস্থ হলে তারা চলে গেল। আরেক দুঃখের গল্প শুরু হল — পাশের ঘরের কমবয়সি এক আয়া, নাম কাশ্মীরি, তাকে ডেকে এনে মাসিরা গল্প শুনছিল। কাশ্মীরি বলছিল, ‘বরটা আমার অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলল, গাড়ি চালানোর কাজ করত, বুকে লাগল, গাড়ি চালাতে পারে না। তারকলে কাজ নিল, সেই কাজ করতে গিয়ে চোখে তার ঢুকে গেল, চোখ গেল। এখন আর কিছুই করতে পারে না। আমি তাই কাজে লাগলাম, নইলে আমায় কাজ করতে দিত না। এখন আমি যা নিয়ে যাই তাতেই দুজনে চালাই …’
আজ আমার দাঁড়ি গোঁফ সব কামিয়ে দেবে — অপারেশনের জন্য — গত চল্লিশ বছরে একবারও কামাইনি — দুঃখ হচ্ছে, কেমন একটা অপমান বোধ — যাকগে — এও একরকম যাত্রা — সেই বালককালের দিকে।
২
দাঁডি-গোঁফ কামানো মুখটা আয়নায় দেখলে হাসি পাচ্ছে — মনে হচ্ছে, জামাকাপড় খুলে নাঙ্গা করে দিয়েছে। সত্যিই নাঙ্গা করে দিয়েছিল। শুধু দাঁড়িগোঁফ নয়, সর্ব অঙ্গ কামাতে যে এসেছিল — সে এই বেডের উপর — এই চারজন রুগীর ঘরের মধ্যে, সকলের আনাগোনার ভিতর, আমার লজ্জাকে ধর্ষণ করে রেখে গেছে। আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না এদের এই প্রাইভেসি হত্যার ব্যবস্থা দেখে। আমার কোনো প্রতিবাদে কেউ কান দেয় নি — কারণ আমি দোষী। একজন রোগী এবং আসামীর মধ্যে এও আরেকটা মিল, যাতে ‘দাবাখানা’ ও ‘জেলখানা’ একইরকম মনে হতে পারে। আমি এসব সহ্য করে নিচ্ছি — আফ্রিকান গল্প, টুইসডে উইথ মরিস ও নির্মলকুমার বসুর পরিব্রাজকের ডায়েরি পড়ে। কারণ আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় উপস্থিত থাকতে পারছে না।
৩
আজ আমার অপারেশন ক্যানসেল হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি খবর পাঠিয়েছেন, আজকের বদলে আগামীকাল করবেন। ভোরে উঠে চান করে প্রস্তুত হয়ে বসেছিলাম — ফুসফুসের জবাই আরেকদিন পিছিয়ে গেল। ভোরে উঠে ছুটে এসেছিল আপনজনেরা — সবাই ক্লান্ত-নিরাশ হয়ে ফিরে গেল। আবার কাল ভোরে উঠে ওদেরকে ফিরে আসতে হবে, তারও চেয়ে বেশি, সবাইকে আরও একদিন চূড়ায় ওঠা উদ্বেগ বুকের মধ্যে চেপে রাখতে হবে।
মাসিরা আজ খুব উত্তেজিত। একজন মাসি বলছেন, ‘এই নার্সিংহোমে মাসিরা এক না। আগে ডিম দিত, দুধ দিত, ছানা দিত — এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। আজ যদি বলি, ‘চলো সবাই মিলে গিয়ে কই’, একটা খানকিও যাবে? ছাঁটাইয়ের ভয়! আরে আমাকে তোকে — সবাইকে ছাঁটাই করবে? নার্সিংহোম চলবে মাসিদের ছাড়া?’ এত কম মাইনেতে কোন মাসি আসবে কাজ করতে? এমন ছিল না। লালরা, ছিপিএমরা কখনও বলেনে গরিব হঠাও — গরিব হঠাও বলে ওই হাতরা আর তৃণমূল।’ আরেকজন মাসি সমর্থন করে ‘এরা বেশিদিন টিকবে না’। ৩ নম্বর পেশেন্টের বাড়ির লোকেদের খুবই দাপট — এরা যখন খুশি আসে। ম্যানেজারের দাদা — এদেরই একজন, বলছিল, ‘কি গো মাসিরা তোমরা মমতাদিদিকে ভোট দেবে তো’ — মাসিরা চুপ করে ছিল। একজন মাসি বলল, ‘আমি বাবা কান্তিবাবুকে ভোট দেব, উনি সুন্দরবনে, আমাদের ওখানে অনেক কাজ করেছেন।’ দু-জন মাসি মুখ খুলল, ‘লোক দেখে ভোট দেওয়াই ভালো, পার্টিগুলো সব এক।’
মাসিদের সঙ্গে গল্প করে জানা গেল সবাই দক্ষিণের লোক — মথুরাপুর, লক্ষ্ণীকান্তপুর। এদের মাইনের ১২০ টাকার ৪০ টাকা কেটে নেয় নার্সিংহোম, তিনবেলার খাবারের দাম হিসেবে (সকালে দুটো হাত রুটি তরকারি, দুপুরে ডাল-ভাত-তরকারীর সাথে মাছ বা ডিম)। ৬ টাকা কেটে নেয় মাসিদের সেন্টার, প্রত্যেক মাসি হাতে পায় ৭৪ টাকা ১২ ঘন্টা কাজের বিনিময়ে। এখানে মাসিরা টানা পাঁচ-সাত দিন কাজ করে। এক একজন রোগীকে ধরে, যে রোগী যত দিন থাকে ততদিন টানা ডিউটি — কাজ রাখতে গেলে এটাই নিয়ম। মাসিরা বলল, আমাদের বয়স হয়েছে, আমরাই এই কাজ করি, ইয়ংরা কেউ এই নার্সিংহোমে আসে না। কথাটা সত্যি। আরেকটা সত্যি কথা হল — এরা সকলেই প্রায় মুসলমান। কলমা পড়ার কথা, পীরের মাজার থেকে রুগীর জন্য বাতের তেল এনে দেওয়া, মোবাইলে ছেলেকে ডেকে আব্বাজানকে খবর দেওয়া — এসব শুনে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরা যে পরিচয় খুব লুকিয়ে রাখে তাও না। তবু ছোটো নার্সের নাম কী জিজ্ঞেস করায় ১ নম্বরের মাসি বললেন ‘রীজা’। আমি ছোটোনার্সকে তাঁর নাম ‘রীজা’ কিনা জিজ্ঞেস করায় আলতো করে হুঁ বলে চলে গেল, অথচ বড়ো নার্স ছোটো নার্সকে ডাকলেন ‘রেহানা, শুনে যাও’। পরে জিজ্ঞেস করায় রেহানা বলল, ওর নাম রেহানা। এখানে সব মিলেমিশেই আছে। ১ নম্বরের মাসি তাঁর সেরিব্রালে আক্রান্ত পুলিশ পেশেন্ট মিঃ মাইতির বাড়িতে যাওয়ার জন্য কাঁদার সময়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়। গান গায় বাচ্চা ছেলেকে ভোলানোর মতো — ‘ও তোতা পাখিরে’ আর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’। মাসির পদ সুর সব ঠিকঠাক না হলেও দরদের কোনো কমতি নেই। তাড়াহুড়োর জীবন থেকে সরে আসায় দরদটুকু নজরে পড়ে।
একটু আগে। রেহানা
এসে বলে গেল — ‘কী লিখছেন একটু পড়তে দেবেন’। আমি বললাম — ‘হ্যাঁ’।
Leave a Reply