কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল, মন্দিরতলা, ৫ সেপ্টেম্বর#
বিদ্যাসাগর সেতুর টোল ট্যাক্স পেরিয়ে উড়ালপুলের একটা রাস্তা নেমেছে শিবপুর মন্দিরতলায়। মন্দিরতলা জমজমাট জায়গা। খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকান, ওষুধের দোকান, বাসস্টপ। সব মিলিয়ে একটা জংশন পয়েন্ট। বাস থেকে নেমে বাঁদিকে ঢুকতেই, ঠাকুরদালান সংলগ্ন মাঠ, যেখানে দুর্গাপুজো হয় খুব জাঁক করে। একটু এগোলেই বাঁদিকে উড়ালপুলের নিচে সাইকেল স্ট্যান্ড, মোটরবাইক স্ট্যান্ড চোখে পড়ে। মানুষজন এখানে বাস থেকে নেমে সাইকেল বা মোটরবাইক নিয়ে কদমতলা রামকৃষ্ণপুর এসব জায়গায় নিজ বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
আসলে এই গৌরচন্দ্রিকাটুকুর প্রয়োজন এ কারণেই, আমরা যদি উড়ালপুলের নিচের রাস্তাটা ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে ব্যাতাইতলার দিকে এগোই, সামনেই পড়বে নব মহাকরণ। ১৪তলা বিশাল সাদা বাড়ি (নাঃ, ভুল বললাম, এখন নীল সাদা)। কেউ বলে ষোলো তলা, ভূমিতলের নিচে নাকি আরও দু-তলা আছে। হওয়ার কথা ছিল গার্মেন্ট পার্ক, হয়ে গেল নতুন রাইটার্স বিল্ডিং। সাইকেল স্ট্যান্ড মোটরবাইক স্ট্যান্ড এখনও আছে। যেসব দোকানপাট ছিল (চা, খাবারদাবার), তার অনেকগুলোরই ঝাঁপ পড়ে গেছে। আরও এগোই, নব মহাকরণ যত কাছে আসে, চোখ পড়ে উড়াল পুলের নিচে একসময় গড়ে ওঠা নবপল্লি (নবপল্লি নামটা ভুল বললাম কি?)-র দিকে। গতকাল যা নতুন, আজ তা পুরোনো, আবার আজ যা নতুন, আগামীকাল তা পুরোনো। ইতিমধ্যেই দরমা ঘেরা টালির ঘর ভেঙেচুরে তছনছ।
কাঠের চৌকির একধারে ঝুলে থাকা মশারির সঙ্গে লেপটে থাকা লোলচর্মা এক বৃদ্ধা। কমলা ঘোরুই। বয়স কত হল ঠাকুমা? একশো পঁচিশ একশো তিরিশ হবে। পাশে বসে থাকা এক মহিলা বলেন, একশোর ওপরে বয়স। এখানে কবে এসেছিলেন? এই তো বাবা, ব্রিজ হওয়া থেকে আছি। ষষ্টীতলায় কুঁড়ে করে ছিলাম। যখন পাড়ার ক্লাবঘর হল, এখানে উঠে আসতে হল। থাকতে দিলে না। আর কোথায় যাব? এখানে থেকেই চলে যেতে চাই। এক যুবক বুদ্ধ মণ্ডল, রিক্সা চালান। আগে কোথায় ছিলেন? ব্রিজ হওয়ার আগে মাকে নিয়ে এক বাড়িতে ছিলাম। মা তাদের বাড়ির কাজকর্ম করত। ব্রিজ হলে যখন সবাইকে কোয়ার্টার দিল ডুমুরজলায়, আমাদের উঠে আসতে হল এখানে ব্রিজের তলায়। কাগজপত্র তো কিছু ছিল না, ভাড়াটেও নই, তাই …। কথা হল, সাধনা পণ্ডিতের সঙ্গে। লোকের বাড়ি কাজ করেন। স্বামী নেই, দুটি ছোটো ছেলে। বললেন, দেখি দূরে কোথায় ঠাঁই পাই। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান মৌসুমি মণ্ডল। শরীরে আসন্ন মাতৃত্বের সম্ভাবনা। বললেন, আমার এই অবস্থায় যাই কোথায় বলুন তো। আমার স্বামী শুধু ঘরামির কাজ করে। বুদ্ধ মণ্ডল বলেন, এখানে আমরা পঞ্চাশ ষাট জন ছিলাম। আর সব মিলিয়ে ব্রিজের এদিকটাতে তা শ-দেড়েক তো হবেই। বেশি তো কম না।
চলে আসতে যাব, হঠাৎ চোখ পড়ে, কমলা ঠাকুমার ঠিক উল্টোদিকে চৌকির ওপর আধশোয়া অবস্থায় আরেক ঠাকুমার দিকে। পাশে বসে থাকা একটা বাচ্চা আগলাচ্ছেন। নাম জিজ্ঞাসা করতে বলেন, বিমলা কুর্মী। উল্টোদিকে কমলা ঠাকুমাকে দেখিয়ে বলেন, ওইটা আমার দিদি। আমরা দুই বোন এখানে এসে এইদিকে সংসার পেতেছিলাম। এখানে থেকেই ছেলেমেয়েদের বড়ো করেছি। ঘর ছিল শ্যামপুর, বাঁধের ধারে (রূপনারায়ণ নদী সম্ভবত)। নদীর পাড় ভাঙতেই এদিকে এসে প্রথমে ষষ্টীতলায় কুঁড়ে করে ছিলাম। তারপর থেকেই এখানে। তখনও ব্রিজ শুরু হয়নি। বনজঙ্গল সাফ করে দরমা দিয়ে ঘর করেছিলাম। আমি কারোর সাহায্য ছাড়া লাঠি হাতে উঠে দাঁড়াতে পারি না বাবা। পড়ে গিয়ে কোমরের বল ভাঙল। যে বাড়িতে কাজ করতাম, সে বাড়ির এক মেয়ে ভালো চাকরি করে। সে-ই মেডিকেলে ভর্তি করে অপারেশন করে আনল। সত্তর হাজার টাকা লেগেছে। আমার কিছু ছিল, বাকিটা সে দিয়েছে। আমি এখান ছেড়ে বউমাদের কাছে যাব না। এখানে থাকি, এই যে বাড়িগুলোতে কাজ করতাম, তাদের কাছে কোনোভাবে যেতে পারলে কিছু দেয়। আমার খাওয়া জুটে যায়। এখানে থেকেই মরে গেলে বাঁচি। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। খারাপ লাগে দাঁড়িয়ে থাকতে। শমীককে বলি, চলো, অন্যদিকে যাই। সরে আসি। মনে পড়ে, কোনো পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার সংলাপ — ‘ইট কাঠ পাথরের বাড়ি নয়, ঘর বানিয়েছিল মানুষ। হাজার হাজার বছর লেগেছিল মানুষের সেই ঘর বানাতে।’
এগিয়ে যাই নব মহাকরণের দিকে। বাঁদিকে চোখ পড়ে। গাড়ির গ্যারেজ গজিয়ে উঠেছিল। বেশিরভাগই নেই। ঘুরতেই, নব মহাকরণের উল্টোদিকে যে চা আর খাবারদাবার বিক্রির দোকান ছিল, সেই জায়গাগুলোও ফাঁকা। তার পেছনে জায়গা ঘিরে তৈরি হচ্ছে মহাকরণ সংলগ্ন পার্কিং লট। আরও এগোই। মাঝখানে আইল্যান্ডে বিদ্যাসাগর মূর্তি আর বাচ্চাদের খেলার পার্কটা আছে। কিন্তু উল্টোদিকে কর্নার করে থামের গায়ে একটি মেয়ের দোকান ছিল টুকিটাকি জিনিসের। সেখানে এখন শুধুই দেওয়াল।
টোল ট্যাক্স থেকে ওয়াই শেপ-এর যে রাস্তাটা নামছে, তার ডানদিকে পুলিশ ফাঁড়ির গায়ে নতুন রঙ পড়েছে। যে পুরোনো বাড়ির কঙ্কালগুলো পড়েছিল, সেগুলো হাওয়া। এপাশের বড়ো বড়ো গাছগুলো মুচরিয়ে কাটা হয়ে গেছে। বাঁপাশে ছিল গরুর খাটাল। এখন তা শূন্য দুয়ার। সামান্য কিছু শাকসবজি চাষ করত কো্নো মানুষ। তা আর নেই। সে জায়গায় দু-পাশে জলভরা পরিখা। সিইএসসি-র কাজ হচ্ছে। ব্রিজের ধার ধরে ধরে এগোই ব্যাতাইতলার দিকে। ব্রিজের তলায় যতদূর চোখ যায়, ফাঁকা জায়গা বেরিয়ে পড়েছে। বুলডোজার ক্রেন ডাম্পার মিক্সার — এইসব মেশিন এসেছে। লাল সুরকি পড়ছে। রাস্তা হবে। হবে বাসস্ট্যান্ড। দক্ষিণপাড়ায় দুর্গা মণ্ডপের উল্টোদিকে যে ফুলের বাগান হয়েছিল টব সাজিয়ে, তা আর নেই। মুখ্যমন্ত্রীর ছবিটাও একদিকে হেলে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে। এখানেও গাড়ি থাকত অনেক, আর ছিল স্ব-উদ্যোগে গড়ে ওঠা কুমোরটুলি। প্রচুর ঠাকুর তৈরি হত। বাঁ হাতে বড়ো মদের দোকান কাম বার। তার উল্টোদিকে, অল্প কিছু ঠাকুর প্লাস্টিক চাপা দেওয়া। কুমোরটুলি এখন সরতে সরতে ব্যাতাইতলা মনসাতলার কাছে এসে গেছে। প্রচুর ঠাকুর জড়ো করা দেখতে পাই।
মনসাতলার উল্টোদিকে ব্রিজের তলায় ঢুকে পড়ি। একজন মাঝবয়সী মানুষ, মাথায় টাক, এককোণে একতাল মাটি দিয়ে মা দুর্গার অসুরের গায়ে লাগাচ্ছেন। নাম কার্তিক চন্দ্র দে। জিজ্ঞাসা করি, কবে থেকে এখানে? বলেন, ব্রিজ শুরুর পর থেকে এখানে ঠাকুর গড়ছি। ঠাকুর গড়া জাতিগত পেশা নয়। বাবা চাকরি করতেন রেলে। পাঁচ ভাই। একটা কিছু তো করতে হবে। এই কাজ শিখতে শুরু করলাম। বড়ো হতে অনেক জায়গায় গেছি। শিলং-এ ছিলাম অনেক বছর। মালিক এখানে ফিরিয়ে আনল। কালিবাবুর বাজারে ছিলাম। তারপর এখানে। এই ঠাকুর গড়েই তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছি ভালো ঘরে। এই কাজে তিনশো টাকা রোজ। অন্য কোন কাজে হবে বলুন?
এসে দাঁড়িয়ে মিঠুন মণ্ডল। ও শিল্পী নয়। তবে এখানেই ঠাকুর গড়ার ব্যবসা। বলে, এখানে অনেক সুবিধা ছিল দাদা। পাড়াটাও ভালো। ব্রিজের তলায় কোনো ছাউনির দরকার হয় না। পুলিশের লোকজন এসেছিল। এখনও সরে যেতে বলেনি। পুজো পর্যন্ত তো আছি। তারপর কোথায় যাব, জানি না। নাগরিক অভ্যাস থেকে খোঁচাতে ছাড়ি না। বলি, মিঠুন, লোকে বলে এই সার সার ঠাকুরের আড়ালে অনেকে নেশাভাঙ করে। মদ গাঁজার ঠেক তৈরি হয়েছে। কথা শেষ করতে পারি না। মিঠুন বলে, সেসব কোথায় নেই দাদা? ওই যে ফ্ল্যাট বাড়িগুলো দেখছেন, ওখানকার লোকজন খায় না? বড়ো লোকেরা খেলে বলে, ড্রিঙ্ক করছে। গরিব হলে বলে, মাতাল। কত লোক আসে ঠাকুর নিতে বায়না করতে। তারা একপাশে সরে গিয়ে যদি খায়, তো আমি কি না করব? তাছাড়া এই লাইনে খাটুনিও খুব যায়। এত খাটে, তাদেরকে একটু আধটু খেতেও হয়। চোখ যায় পেটমোটা গণেশ মূর্তির দিকে। এত কালারফুল (গোলাপি গা, মাথায় গলায় সোনা রঙের মুকুট, গয়না), দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনসাতলার মুখেও দেখি এক বিশাল গণেশ মূর্তি রঙ হচ্ছে। এদিকে বিশ্বকর্মা দুর্গা সব ঠাকুর হচ্ছে।
ব্রিজের তলায় কাঠের গোলা হয়েছিল অনেকগুলো। এক সকালে মানি পিসি আমাদের বাড়ি এসে হাজির। তাঁর ছেলেদের কাঠের গোলা তুলে দিচ্ছে। তিনি জিনিসপত্র রাখতে এসেছেন। ব্যাতাইতলায় একটা বড়ো গোলা এখনও অক্ষত। দেখা হয় টুকাই ও ছোট্টুর সঙ্গে। ব্রিজ শুরু থেকেই ওদের গোলা আছে। না, এখনও উঠে যেতে বলেনি। কদিন আগে বাড়িতে পুরোনো ইট রেখে দিয়ে গেছে কিশোর। ভ্যানচালক। কিশোর ওর শক্তপোক্ত চেহারার মতোই ভ্যানটাকে শক্তপোক্ত করে রেখেছে। দেওঘরে বাড়ি। এখানে থাকত ব্রিজের তলায়। এখন পুজোর পরে কোথায় যায়। ওর কথায়, ঠাকুর যেদিকে নিয়ে যাবে। ওর মতো অনেক খেটে খাওয়া মানুষ থাকত ব্রিজের তলায়। পুলিশ নাকি কয়েকজনকে আটশো চল্লিশ টাকা করে ফাইন করেছে। তারা পালিয়েছে দেশে। অন্যরা চেয়ে আছে, ঠাকুর যেদিকে নিয়ে যাবে।
Leave a Reply