কাজরী রায়চৌধুরি, কলকাতা, ২৮ ফেব্রুয়ারি#
কলকাতার নরম শীতের আমেজকে সঙ্গী করে আমরা চার বান্ধবী সন্ধ্যের ভাগীরথি এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। দিনটা ছিল ১৪ ডিসেম্বর। গন্তব্য কৃষ্ণনগর হয়ে মায়াপুর। আমাদের আসন সংরক্ষিতই ছিল। ফলে আড্ডা এবং আন্ডার সহবতে শুরুটা ভালোই হল। শুধু সামনে ক্লান্ত নিত্যযাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকাটা খানিক পীড়া দিচ্ছিল।
রাত ৮।২৫ এ কৃষ্ণনগরে নামলাম। সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যা। স্টেশনের বাইরে কৃষনাগরিক এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। ঘন্টা দেড়েক পথ আমরা প্রায় বিদ্যুৎবাতিহীন অমানিশায় ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে ছুটে চললাম। সম্বল শুধু গাড়ির কুয়াশা ধূসর স্থিমিত আলো। চারিদিকে একটা গা ছমছমে অতিলৌকিক মায়ার রাজ্য যেন। চলেছি তো মায়াপুরেই। থাকব পূর্ব-নির্দিষ্ট ইসকনের অতিথিশালায়।
রাত সাড়ে দশটারও কিছু পরে বাইরের অন্নপূর্ণা হোটেলে খাওয়া সেরে ঢুকলাম আলোকিত অতিসজ্জিত ইসকনের সুদীর্ঘ পাঁচিল ঘেরা মায়াপুরে। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আর নানারঙের গাঁদাফুলের যত্নশোভিত সমারোহ সেই রাত-বাতির আলোয় আমাদের সত্যিই মোহাচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। এই ফাঁকে বলে রাখি, দিনে ব্যস্ততা থাকায় আমরা সকালের কোনও ট্রেনে যেতে পারিনি। আর তাই মায়াপুরের সাথে আমাদের প্রথম দৃষ্টিপাত অমাবস্যা মাখা শীতকাতর ঘুমজড়ানো রাতে।
পরদিন সকাল ৯টায় চারসখি রওনা দিলাম নবদ্বীপের দিকে ইসকনের ভেতরে তখন কিসের যেন তুমুল ব্যস্ততা। সাহেব-মেমরা বাঙালি পোশাক পরে হাতে জপের থলি নিয়ে কৃষ্ণনাম করতে করতে হেঁটে চলেছে মন্দিরের দিকে। প্রভাত আরতিতে। কারো সাথে মুখোমুখি হতেই মিষ্টি হেসে বলে উঠছেন, হরেকৃষ্ণ। প্রথমে মনে হল ‘হ্যাপি ডে’ শুনলাম। অচিরেই ভুল ভাঙল। মৃদু অস্ফুট থেকে তীব্র ‘হরেকৃষ্ণ’ ধ্বনিতে ইসকনের বাতাস বেশ সরগরম। ছোটো ছোটো সাহেব সন্তানেরা ধুতি-পাঞ্জাবী এবং ন্যাড়া মাথায় বড়ো একখানা টিকি সমেত সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়াপুরের গেট দিয়ে বেরিয়ে হাঁটা পথেই নদী। মাথা পিছু দেড়টাকা পারানি। বেশ লম্বা চওয়া বোট। নৌকার একপাশে আমরা, অর্থাৎ মানুষজন। মাঝে সাইকেলের সারি, অন্যপাশটায় অতি নিরীহ কয়েকটি মোষ। সবাই যাবে নবদ্বীপ। ষোড়শ শতাব্দীতে দুই বাংলাকে জাত পাতের বেড়া ডিঙিয়ে ভক্তি-আন্দোলনএর জোয়ারে প্লাবিত করেছিলেন যিনি সেই চৈতন্যদেবের জন্মস্থান, বড়ো হওয়া, সন্ন্যাস ও গৃহত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত নবদ্বীপ।
নেমে আমরা দু-টো রিকশা নিলাম। প্রতি রিকশা ২০০ টাকা স্থির হল। দেখাবে রাধারানীর মন্দির, সোনার গৌরাঙ্গ, সমাজবাড়ি, রাধাগোবিন্দের মন্দির, গুপ্ত বৃন্দাবন, পোড়া মা তলা। আমাদের উদ্দেশ্য ভক্তির ঘনঘটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে একটু চাক্ষুষ করা, কিন্তু প্রায় সবই এত চাকচিক্যময় যে সেই সময়ের ঘ্রাণ পাওয়া মুশকিল। তারই মধ্যে পরবর্তীকালে তৈরি রাধারানীর মন্দির সংলগ্ন একটি ছোটো ছোটো পোড়া ইঁটে গাঁথা ঘরের ভগ্নাবস্থা চোখে পড়ল। শুনলাম সেই ঘরে চৈতন্যদেরব স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে বারো বছর সংসার করেছিলেন। আর সেই ছোট্ট এক চালা ঘর থেকেই তাঁর গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাসগ্রহণ। ঘরটা অযত্নে রক্ষিত, আগাছা এবং আবর্জনায় ভরা। অথচ দু-ফুট দূরত্বেই চক বাঁধানো বিশাল মন্দিরে অষ্টপ্রহর আরাধনা চলছে। প্রসাদ পাওয়ার আশায় তখন হতভাগ্য অনাথিনীর ভিড়।
রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দিরও শ্বেতপাথরে তৈরি পরবর্তীকালে স্থাপিত, মাথার ওপর কারুকার্য খচিত ঝাড়বাতি। চৈতন্যদেরবের অতিসাধারণ জীর্ণ খড়মের সামনে এক জোড়া রূপোর পাদুকার ওপর ফুলের ভার, তার পাশের দেওয়ালে খোদাই করা ভাগবতের বাণী, যার মূল কথা, সেই প্রেমই প্রকৃত প্রেম যেখানে ‘কাম গন্ধ নাহি তায়’। কিন্তু চৈতন্যদেব যেভাবে চন্ডীদাস-গোবিন্দদাসের পদ আস্বাদন করতেন, যেভাবে কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর ছিলেন এবং মধুর রসকেই শ্রেষ্ঠ মনে করতেন, তার সাথে এ বাণী খাপ খায় না।
সমাজবাড়িও শ্বেতপাথরের তৈরি বিশাল নাটমন্দির প্রায় আট ফুট উচ্চতা ও সেই অনুপাতে চওড়া একটা জালা রাখা আছে। গায়ে লম্বাটে অনেক ছিদ্র ওটা প্রণামীর কুম্ভ। প্রতি সন্ধ্যায় নামগানের জন্য বড়ো চাতাল বাগান ও উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। নাটমন্দিরেও তখন প্রসাদের লম্বা লাইন। বহু বয়স্ক অনাথ-অনাথিনীর জীবনের শেষ আশ্রয় এই মঠ মন্দিরগুলো। পাঁচিলের বাইরে বেশ কতগুলো দোকানে পূজোর উপাচার বিক্রি হচ্ছে। তার মধ্যে নানা মাপের তুলসি দানার মালা অর্থাৎ কন্ঠী ঝুলছে। হস্তশিল্পের নমুনা ও নবদ্বীপের স্মৃতি। কিনে ফেললাম চারখানা। চারবন্ধু গলায় পরতেই অমোঘ ধ্বনিটি বেরিয়ে এলো — হরেকৃষ্ণ। এর পরের গন্তব্য পোড়া মা তলা। রিকশার পথ সংকীর্ণ। নবদ্বীপকে কল্পনা করেছিলাম গ্রামবাংলার শেষ রেশটুকুর মধ্যেই, অথচ ইতস্ততঃ পরিকল্পনাহীন গজিয়ে ওঠা দোকান, বাজার, ফ্ল্যাটবাড়ি মনটাকে দমিয়ে দিচ্ছিল। মোবাইলের দোকান, তার পাশে কম্পুটারের পার্টস বিক্রি, বাইক সারানোর গ্যারেজ। রিকশা থামল টেলিফোন বুথ ও সুলভ শৌচালয়ের গা ঘেঁষে একটা বাজারের সামনে। বিক্রি হচ্ছে পূজোর ফুল মালা শাঁখা পলা সিঁদুর আলতা বাতাসা কদমা এবং খেলনাপত্র। প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ঝুপড়ি দোকান পোড়া মা তলার প্রাঙ্গনকে ঢেকে ব্যবসা করছে। একটা বুড়ো বড় গাছ, বয়স হবে পাঁচশ’ বা তারও বেশি। তার ঝুরি থেকে আবার কান্ড গজিয়ে দশফুটের মধ্যেই আরও শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে শাখাবট। আকাশের দিকে তাকালে বিরাট একটা প্রান্তর জুড়ে শুধু বটপাতার জাফরি চোখে পড়ে। সেই গাছ দুটির প্রধান কাণ্ডের কোটর ছোটোখাটো মন্দিরের গর্ভগৃহের মতোই প্রশস্ত। ভেতরে কালীমূর্তি। কোটরের মুখে গ্রিলের গেট লাগানো। পেছনে একটি বহু পুরনো মন্দ্রিরের ধ্বংসস্তুপ। আর শাখা বটটির কাণ্ড আগুনে পুড়ে কালো মূর্ত্তির আকার ধারণ করেছে। সেখানেই পূজোর বেশি ধুম। ভক্তদের কেনাকাটা-হুড়োহুড়ি, পুরোহিতে হাঁকডাক, ভিখারিদের কাকুতিতে অমন প্রাকৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী জায়গাটা কার্যত নরকে পরিণত হয়েছে। উন্নয়ন ও ভক্তকূলের যৌথ আগ্রাসন অতীতের মাটির গন্ধকে মুছে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে যেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এবার গিরে চললাম নবদ্বীপ নদীর ঘাটের দিকে। কিন্তু চৈতন্যদেবের জন্মভিটে তো দেখা হল না। আবছা স্মৃতিতে ছিল নিমগাছ, পুকুরঘাট আর কুঁড়েঘর — বইয়ে পড়া। চালকদের বলতেই তারা বললেন যে ওটা প্রাচীন নবদ্বীপ। ওখানে দেখার কিছুই নেই। কেউ যায় না। সবাই একটাই দেখে, পূজো দেয়। আমরা জেদ ধরলাম, ওখানেই যাব। এই চালকরা সেই ‘পশ্চিমপ্রান্তে’ যেতে রাজি হল না। তাই আমআ নদীর ঘাটে নেমে অন্য দ্যটো রিকশা ধরলাম। দুপুর ১টা থেকে ৩টে মন্দির বন্মধ থাকবে। তবে ভিটে দেখা যাবে। তাই সই। আমরা আবনার নতুন উদ্যমে ভিটের টানে রিকশায় চড়ে বসলাম।
এবার আর নবদ্বীপ আমাদের হতাশ করল না। রাস্তা ক্রমশ ফাঁকা হতে লাগল, পথে বড়ো বাড়ির বদলে একতলা চালাঘর, পুকুর আর গাছের সারি চোখ জুড়িয়ে দিল। ঘন্টা আধেক চলার শেষে উঁচু পাঁচিল দেওয়া গেটের সামনে রিকশা থামল।। গেট দিয়ে ঢুকতেই এক ভিখারিনী বলে উঠলেন, ‘কী হতভাগিনী তোমরা গো, মন্দিরের বন্ধ দরঝা দেখতে এলে! কী আর করা। এগিয়ে গেলাম সামনে। খুব ছিমছাম শান্ত নিরাভরণ বাগান ঘেরা পরিসর। একটি মাটির কুঁড়েঘর, ওপরে খড়ের চাল। তার দাওয়ায় শচিমাতা নিমাইকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। মাটির মূর্তি। পাশেই সেই নিমগাছ। পাশ দিয়ে তখন বয়ে যেত গঙ্গা। অন্যপাশে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। তিনটের আগে দরজা খুলবে না। না খুলুক। হাজার হাজার দর্শনার্থী নবদ্বীপে এসে জন্মভিটে না দেখেই চলে যায়। আমরা সেই আসল সম্পদটির দেখা পেলাম। এবার ফিরে চললাম ন্দীর ঘাটে। নৌকা পেরিয়ে আবার মায়াপুরে।
হোটেলে খেলাম গরম ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, ফুলকপির ডালনা, মুরগির মাংস। মাত্র ৪৫ টাকায় এই পড়ন্ত দুপুরে এমন মিল মিলবে ভাবতেই পারিনি। অমৃত খেলাম যেন। খেয়ে ঘুম বা ক্লান্তির বদলে মহাশক্তি ফিরে এল। এখন ঘরমুখো হওয়ার প্রশ্নই ওঠে। অতএব, চরৈবতি বলে চেপে বসলাম সাইকেল ভ্যানে। এতক্ষণ দুটো রিকশা নিতে হয়েছে বলে চারজনই একসাথে কলকলিয়ে উঠতে পারিনি। এবার সে বাধা দূর হল। চলেছি বল্লাল সেনের ঢিবি, চাঁদ কাজীর স্থান এবং ইসকন নির্মিত মায়াপুর দেখতে। ১৯৮৩ সালে সরকার ঢিবিটি অধিগ্রহণ করে খননকার্য শুরু করে। অসম্পূর্ণ। যেটুকু দেখা গেল, উঁচু দীর্ঘ ছোটো পোড়া ইঁটের পাঁচিল এবং ইঁটের দোচালা ঘরের আভাস। ঢিবির বাকি অংশ ঘাসে মোড়া। তখন সূর্যাস্তের মিঠে আলোয় আমরা চারজন ঢিবির চূড়ায় দাঁড়িয়ে নীরবে অনুভব করছি ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধনমান’।
চৈতন্যদেবে চাঁদ নামক এক কাজীকে বাঁচিয়েছিলেন তার নামেই এ জায়গার নাম। এখানে একটি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। অশত্থ গাছ আর গোলক চাঁপা গাছ একদম পাশাপাশি উঠেছে। দুটি কাণ্ড। একসময় মিলে গিয়ে পাঁচটি শাখায় ছড়িয়ে গেছে। ভক্তরা কল্পনা করে, এটি রাধাকৃষ্ণের প্রতীক। আর পাঁচটি শাখা জগাই মাধাই গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও কাণ্ডের তিনটি গিঁটে স্থানলাভ করেছেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরাই এ কাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। আপাতত ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু …’।
ফিরতি পথে এবার ইসকনের রাজ্যে। শুনলাম কয়েকজন আমেরিকান বৈষ্ণব এখানে কয়েক হেক্টর মুসলিম প্রধান গ্রাম কিনে নেয়। জায়গাটার নাম ছিল মিঁয়াপুর। কালক্রমে আমেরিকান বৈষ্ণবদের আগ্রাসনে বা ধর্মপ্রাণে নাম হয় মায়াপুর। সারা সকাল নবদ্বীপে গিয়ে যা যা দেখলাম, এমনকি নিমগাছ সহ জন্মভিটে পর্যন্ত — সবেরই আরো মার্জিত, সজ্জিত, আধুনিক প্রতিলিপি এ মায়াপুর। তার থেকেও বড়ো কথা, এদের দাবি এগুলোই আসল। এই মায়াপুরেই চৈতন্যদেবের জন্ম-কর্ম। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ স্বদেশি-বিদেশি মায়াপুরে আসছে এবং নকল চৈতন্যস্থান দেখে গিরে যাচ্ছে। আর অবহেলায় অযত্নে পূজোর অত্যাচারে উদাসীন পড়ে আছে ইতিহাস। বুঝলাম, অচিরেই প্রাচীন নবদ্বীপ হারিয়ে যাবে। চৈতন্য্যভূমির নতুন ইতিহাস তৈরি করবে ইসকন।
সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ ইসকনের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকলাম গেস্টরুমের উদ্দেশ্যে। দেখি সারা রাস্তা জুড়ে আলপনা। দিচ্ছে সাহেব-মেম এবং এদেশিয় ভক্তরা। খুবই ব্যস্ততা যেন। একটু এগোলেই দুটি বিশাল আকারের মোষে টানা রথ। রথে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। সাজানোর শেষ টান চলছে। দর্শনার্থীর ভিড়ে হাঁটাই দায়। আর একটু এগোতেই দেখি দুটি হস্তি শাবক দাঁড়িয়ে লেজ আর শুঁড় দোলাচ্ছে। পিঠে তিনজন করে ভক্ত। এবার তো জানতেই হয় ব্যাপারটা কী! শুনলাম শনিবার দিন, তাই হস্তি পরিক্রমা হবে। মন্দির চত্বরে মাইকে নামগান করতে করতে ভক্তরা চলেছে। সঙ্গে রথ ও হাতি দুটি। এই কৃষ্ণপ্রেমের উন্মাদনা দেখবারই বটে। সাহেব-মেমদের চোখে জলের ধারা, হরেকৃষ্ণ ধ্বনি থেকে থেকে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছে।
মন্দির সংলগ্ন অতিথিশালা ‘শঙ্খ’-তে আমাদের ঘর। সারাদিনের শেষে সাড়ে ছ’টায় ঘরে ঢুকেই গা এলিয়ে দিলাম। এদিকে সকালেই ভেবে রেখেছিলাম সন্ধ্যা আরতি দেখব। সে কথা উঠতেই বন্ধরা একে একে বলে উঠল, যেতে কি হবেই? না গেলে কী হয়? একটু উঁকি দিয়েই কি চলে আসা যাবে? তোমরা বাপু যাও, আমি শুলাম। তা কি হয়, এতদূর এসে মন্দিরই দেখব না? শেষে ঘন্টাখানেক পর আমরা চারজনই গুটিগুটি পায়ে মন্দিরে ঢুকলাম। এতবড়ো মন্দির? এ যে গোটা কয়েক কনফারেন্স হলকে হার মানায়! বিগ্রহ বলতে রাধাকৃষ্ণ আর সখিরা। রাধা একেবারে মেমসুলভ। কৃষ্ণও তাই। আর সখিদের মুখের ধাঁচ মনিপূরীদের মতো গোল, বড়ো, চ্যাটালো। এখানে প্রায় সব বিগ্রহই মণিপুরী আদলের। মণিপুরের সংস্কৃতি ও কারিগরদের সৃষ্টি এই মূর্ত্তিগুলি। আমরাও ঢুকলাম আর আরতি শেষ হল। পাশে প্রায় শ’চারেক নারী-পুরুষ মেঝেতে বসে। মাইকে নানা সুরে লয়ে গলে হরেকৃষ নামগান সহ সমবেত নৃত্য চলছে। পরিবেশনায় ন্যাড়ামাথা টিকিধারী সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত জনা তিরিশ সাহেব, সেই নাচের তালে দু-হাত ওপরে তুলে শ-চারেক শ্রোতা দর্শকও সঙ্গত করে তুলেছে। দৃশ্যের অভিঘাতে আমরা বাক্যিহারা। ঘরে ফিরলাম আটটা নাগাদ। হরেকৃষ্ণ আমাদের শরীরকেও দুলিয়ে ছেড়েছে। দু-হাত তুলে আমরাও কিছুক্ষণ বন্ধ ঘরে নাচের মহড়া দিলাম।
নৈশভোজের ঘন্টা পড়ল। সকালেই টিকিট কেটে রেখেছিলাম। নিরামিশ আহার প্রতি প্লেট চল্লিশ টাকা। বসলাম শতরঞ্চি পাতা মেঝেতে। থালা রাখার জায়গাটা একটু উঁচু করে বাঁধানো। এক ব্যাচে প্রায় পাঁচশ’জন খেতে পারে। প্রত্যেকটা গামলার নিচে চাকা লাগানো। ভাতের গাড়ি, ডালের গাড়ি, সব্জি ও আলুর দমের গাড়ি গড়গড়িয়ে লাইন করে চলে এলো। প্রতিটি গাড়ির সাথে দু-জন করে পরিবেশক। একজন ডান সারিকে অন্যজন বাঁ-সারিকে অতি দ্রুততায় পরিবেশন করে চলেছে। একটি থালা পাঁচ সেকেন্ডে ভরে গেল। সব মিলেমিশে একাকার, ফলে আলাদা করে কোনও স্বাদ পাওয়া গেল না। ঝাল-নুনহীন বৈষ্ণব প্রসাদে পেট ভরলেও মন ভরল না।
পরদিন সকাল ন’টায় ব্যাগ গুছিয়ে ইসকনের মায়াপুরকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা ছোটো গাড়ি করে হাজির হলাম বেথুয়াডহরির জঙ্গলে। ১০ টাকা করে টিকিট কেটে গাইড নিয়ে হাঁটা লাগালাম বনপথে। কলকাতার কংক্রিটে অভ্যস্থ চোখ একটু গাছের সারি, আকাশ আর ফাঁকা জায়গা দেখলেই বিভোর হয়ে যাই। শ্নেছিলাম হরিন আছে এখানে। টিকিটে লেখা আছে, ‘জন্তু জানোয়ারের দেখা না পেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ চারটে ঘরিয়াল আর কিছু পাখ-পাখালি আমাদের দেখা দিল। একটা মাঝারি সরোবরে প্যাডেল বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। আমরা গ্রাম্ভারি লাইফ জ্যাকেট পরে চরে বসলাম বোটে। রত্নাদি কিছুতেই চড়বে না। বলল, ‘তোমরা ঘুরে এস, আমি বসছি।’ জোরজার করে সেই মণির ভাষায় মরণজ্যাকেট পরিয়ে দিলাম। তখন তার অসহায় উক্তি, ‘পড়েছি যবনের হাতে …’। যতই প্যাডেল করে এগোতে যাই নৌকা পিছিয়ে পিছিয়ে যায়। পাড়ের চৌকিদার বলছেন, ভয় নেই ডুবনবেন না। জ্যাকেট পরা আছে। আরে বাবা, ডুবে মারা যাব না, ডাইরিয়ায় মারা যেতে তো বাধা দেখছি না। আধ ঘন্টাখানেক নৌবিহারে রত্নাদির প্যাডেল আর প্রাণখোলা লোকগীতি আমাদের উপরি পাওনা। এবার যাত্রা শুরু। অভিমুখ ঘূর্ণি।
মাটির পুতুলের সারি সারি দোকান। একই সাথে তৈরি ও বিক্রিবাটা। কেনাকাটাও চলছে। খুব সুন্দর শৈল্পিক কাজ। এক জায়গায় মা আর মেয়ে কিনছে। মন বলছে, বাবা আসার আগে ব্যাগে ভরে নে, বাবা কিন্তু এসব কিনতেই দেবে না। রাস্তায় এ দু-দিন যত মহিলার সাথে আলাপ হয়েছে, তারা যখন শোনেন স্বামী সন্তান এক এক খান থাকতেও চার মহিলা বেরিয়ে পড়েছি, প্রথমে এক মুহুর্ত অবাক হয়েই বলে ওঠেন, খুব ভালো করেছেন। পুরুষদের সঙ্গে বেরোনো যায় না। খালি খ্যাচ খ্যাচ করে। কোনও কিছু দেখতে কিনতে দেয় না। আমাদের খুশিতে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আমরা কৃষ্ণনগর স্টেশনে প্রত্যেকের হাতে তিন থেকে চারটে ব্যাগ। চারটে কুড়ি-র কৃষ্ণনগর লোকালের জন্য প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়ছে ভিড়। চলন্ত ট্রেনে উঠে আমরা চারটে সিট দখল করলাম ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’র ভঙ্গিতে। বিনা আঘাতে, বিনা অসুস্থতায় বাড়ি ফিরলাম পরের বারের বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে করতে।
Leave a Reply