শান্তনু রায়, হাঁসখালি, ২০ মার্চ, ২০১৩#
গত ২০ মার্চ বুধবার সকাল ৮টা, শান্তিপুর থেকে আমরা কয়েকজন কবি ও সঙ্গীতশিল্পী বেরিয়ে পড়েছিলাম নদীয়ার হাঁসখালি ব্লকের মামজোয়ান গ্রামের উদ্দেশ্যে। আমাদের মধ্যে ছিলেন সুবীর দাস, দীনবন্ধু সরকার, তাপস সাহা, ভবেশ মাহাতো, প্রভাস মাহাতো, জীবন বোস সহ আরও অনেকে। আমাদের যাবার উদ্দেশ্য ছিল মহাত্মা শ্যামাচরণ শর্ম্ম সরকারের জন্ম দ্বিশতবর্ষ উদযাপন। অনেকেরই জানা নেই শ্যামাচরণ শর্ম্ম সরকার কে? বা কি তাঁর পরিচয়? জানা গেল শ্যামাচরণের জন্ম বিহারের পূর্ণিয়াতে, ইংরাজি ১৮১৪ সালের ২০ মার্চ। তাঁর পিতৃভূমি নদিয়া জেলার হাঁসখালি ব্লকের অধীন মামজোয়ান গ্রামে। বিদ্যাশিক্ষা গ্রামের পাঠশালা, কৃষ্ণনগর ও কলিকাতায়। দুর্ভাগ্যকে কীভাবে জয় করতে হয় আশৈশব নিজের জীবনীশক্তি দিয়ে সেটা প্রমাণ করেছিলেন শ্যামাচরণ। প্রভূত ধন সম্পত্তির অধিকারি হয়েও ভুলে যাননি স্বদেশকে, স্বগ্রামকে। জনহিতব্রতে তাঁর ব্যাপকতর ভূমিকার কথা আজও অনেকের অজানা। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই যে তিনি ১৮টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সুতিকাগার নির্মাণে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক।
আচার্য্য ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কথিত প্রথম রাজনৈতিক সমাজ, ভারত সভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়েছিল ২৬ জুলাই ১৮৭৬. মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শ্যামাচরণ শর্ম্ম সরকার। হাঁসখালি তথা নদিয়ার মানুষ হিসাবে এই তথ্য আমাদেরকেও শিহরিত করে। ভাষাচর্চা, আইনগ্রন্থ প্রণয়ন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, রাস্তা সংস্কার, দানকর্ম প্রভৃতি উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে শ্যামাচরণ বাংলাদেশের নবজাগরণের অন্যতম প্রবক্তা পুরুষরূপে সমকালে সম্মানিত হয়েছিলেন.
আমরা জানতে পারলাম শ্যামাচরণ তৎকালীন কলিকাতায় অবস্থিত সুপ্রীম কোর্টের প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় চিফ ইন্টারপ্রিটার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ঠাকুর আইন অধ্যাপক রূপে সম্মানিতও হয়েছিলেন। এমন একজন মানুষের কথা ইতিহাসের বিস্মৃতি থেকে বার করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মাহাত্মা শ্যামাচরণ শর্ম্ম সরকার জন্ম দ্বিশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির অনুপ চন্দ্র ও গৌতম অধিকারীর ন্যায় ব্যক্তিবর্গ। ২০ মার্চ তাঁর দ্বিশতবর্ষ জন্মদিন উপলক্ষে আমরাও উপস্থিত ছিলাম মামজোয়ান গ্রামে। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ — কৃষ্ণনগর, বগুলা, মুর্শিদাবাদ, শান্তিপুর এবং কলিকাতা থেকে আসা কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষক সহ বহু গুণীজন। অনুষ্ঠান শুরু হয় ভোর পাঁচটায় — ঢাক, ঢোল, বাঁশি, সানাই বাদন ও দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে। তারপর শ্যামাচরণের প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের পর তাঁরই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রী-ছাত্র সহ বহু সাধারণ মানুষ এবং আমরা অনেকে গোটা অঞ্চলটির পথপরিক্রমায় পা মেলাই। সারাদিনের অনুষ্ঠানে আলোচনা ও বিতর্ক সভার সাথে সাথে চূর্ণী নদী বক্ষে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে রইল মামজোয়ান সহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ। অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি হয় কবিতা পাঠ ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যথার্থই মান অর্জন করেন শান্তিপুরের শিল্পী ভবেশ মাহাতো ও শিল্পী শান্তনু রায়ের তবলা সঙ্গত। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন গৌতম অধিকারী।
Leave a Reply