অমিতাভ সেন, মাজু, হাওড়া, ২৩.৩.১৪ #
রূপনারায়ণের সঙ্গে গঙ্গার সংযোগকারি ছোটো একটা নদী। আদর করে নাম দিয়েছে কাণা। কাণাই হয়ে যাচ্ছে নদীটা। নদীর পারে যেখানে সেখানে নদীর খানিক অংশ বুজিয়ে দিয়ে যে যার মতো কাজে লাগিয়েছে — দোকান তুলেছে, ঘর তুলছে। নদীটা এখন সরু খাল। বছর খানেক আগে এসেও যে অবস্থা দেখেছিলাম, তার চেয়েও অবস্থা খারাপ। মাজুতে ছোড়দির বাড়িতে এসে প্রতিবারই এই কাণা নদীর ওপর যে সেতুটা এপারে ভট্টাচার্য পাড়া থেকে ওপারে গয়লাপাড়া গেছে তার ওপর উঠে দাঁড়াই। এবারও দাঁড়িয়েছি। দেখি শীর্ণ নদীর জলে পানা ভর্তি। স্রোতহীন জল স্থির হয়ে দু-ধারের ঝুঁকে পড়া বাবলা গাছের ডালের দিকে মরার মতো চোখে চেয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে ঘোলা ডালপাতার ছায়া।
এখন চৈত্র মাস; বর্ষায় অবশ্য এখনও খানিকটা জল বয়ে যায় এই সোঁতা দিয়ে। আর কতদিন বইবে কে জানে। সময় চলছে। সাঁকোয় ওঠার মুখে বাঁদিকে বাঁশঝাড়ের তলায় লাল মারুতি ভ্যান। ধানখেতের মধ্যে দিয়ে আসা ইটের রাস্তা ঢালাই হচ্ছে, খানিকটা অংশে পিচও ফেলা হয়ে গেছে। এই রাস্তায় এবার অটো ঢুকবে। ভ্যানওয়ালা কচি খুব চিন্তিত — তাদের রুজি-রুটিতে ভাগ বসাবে অটোওয়ালারা। মানুষের সময় মোটর যানের দিকে আরও চলে যাচ্ছে। সাঁকোর ওপারে ডানদিকের রাস্তার ধারে দুটো মাটির দোতলা বাড়ি এখনও টিঁকে আছে। ভারী সুন্দর দেখতে বাড়ি দুটো। একটার গায়ে গাঢ় নীল আর কালো রঙ, মাথায় টিনের চাল। অন্যটায় রঙ নেই — মেটে দেওয়ালের ওপর লাল টালির চাল। দ্বিতীয়টার গা ঘেঁষে ইটবালির পাকা দেওয়াল উঠে মাটির দেওয়ালকে শাসাচ্ছে। সময়ের গাঁথা এই ছবি সামনের দীঘির জলে কাঁপছে। এর কাছেই একটা নতুন বাড়ি মাথা তুলেছে। বেশ আধুনিক চেহারার এই বাড়ির গায়ে লেখা আছে, গোপাল ধাম, সলিল ভবন — গোপালের পূজারি সলিলবাবুর ছেলে এখানে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিস খুলেছে।
বাড়িটার উল্টোদিকে সরকারদের বাড়ি। একসময়ে মাজুর জমিদারদের নায়েব ছিল সরকাররা। এদের বাড়ির দেওয়ালে খিলানে থামে যে অপূর্ব কারুকাজ ছিল তা দেখলে রাজার বাড়ি মনে হত। সেই কারুকাজ খসে পড়তে পড়তে এবারে দেখলাম একেবারে কিছুই নেই — খিলান-থাম সব ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়িটাকে সারানোর মতো অবস্থাও বাড়ির মালিকের নেই। প্রায় সেই পোড়োবাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণে একটা মন্দিরের গায়ে গণেশের মূর্তিটা সংস্কার করায় অটুট রয়েছে। আর তার পাশেই গজিয়ে উঠেছে একটা দোকান। দোকানের নাম ‘ইচ্ছাপূরণ’। সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে দোকানটার নামের পাশে লিস্টি করে লেখা আছে — ‘গিফ্ট, জেরক্স, টেলিকম, পাসপোর্ট, পেট্রল, বীজ।’ এও বোধহয় সময়ের ইচ্ছাপূরণ। ১১২ বছরের পুরোনো মাজু সাধারণ পাঠাগারের পাঠকসংখ্যা সেকারণেই বোধ হয় দিন দিন কমে আসছে।
সময়ের সঙ্গে মানুষের কারবারের অতশত খবর না জেনেই মাজুর পথঘাট সাদা ভাঁটফুলে থই থই।
Leave a Reply