শাকিল মহিনউদ্দিন, হাজিরতন, মেটিয়াবুরুজ#
মাছ ধরার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। নব্য প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ মাছ ধরার বিদ্যেয় হাত পাকিয়েছে, পেটের খিদে মিটিয়েছে। একটা সময় মানুষের যথেষ্ট অবসর ছিল আর বাঙলায় ছিল অসংখ্য খাল-বিল-পুকুর-জলাশয়। ছিল পুকুর পাড়ে বসে নিশ্চিন্তে মাছ ধরা। তাই আজও মুখে মুখে ফেরে এই প্রবাদ — ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে, লিখিব পড়িব মরিব দুখে’। সুস্বাদু, পুষ্টিকর, সহজলভ্য মাছ বরাবরই স্থান পেয়েছে বাঙালির খাদ্যতালিকায়।
ছিপ নিয়ে মাছ ধরার মধ্যে রয়েছে এক নান্দনিক ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছেন গড়িয়ার বোড়াল নতুনহাটের নামকরা মেছুড়ে জয়নাল খাঁ। মেছুড়ে জয়নালকে বহুদূর থেকেই লোকে চেনে। তাঁর পুরো নাম জয়নাল আবেদিন খাঁ। কলকাতার বউবাজারে উমাচরণ কিংবা কাল্টুর মশলার দোকান, গার্ডেনরীচ বাঁধাবটতলার বাবলুর মশলার দোকানে খোঁজ নিলেই জানা যায় মেছুড়ে হিসেবে তাঁর খ্যাতির কথা। হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান ও দুই ২৪ পরগনায় তিনি বেশি পরিচিত। এইসব জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছিপে মাছ ধরার রেকর্ড রয়েছে তাঁর। কলকাতার লালদিঘি, বেলেঘাটার ঝিল, মেটিয়াবুরুজের কয়লাপুকুর, আদমার জলা, সত্যপীর পুকুর, ঠুঁটোর কলে নাটা কার্তিকের পুকুরে মাছ ধরার সূত্রে জয়নালের পরিচিতি ছড়িয়েছে।
আলাপচারিতায় জানা গেল, তিনি ১৬ বছর বয়স থেকেই মাছ ধরা শুরু করেছিলেন। পাস পুকুরে মাছ ধরার জন্য অধিকাংশ সময় তাঁকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হত। ওঁর ফি ছিল সে যুগে ৫০০ টাকা। মশলা নিজের হাতে তৈরি করতেন। পার্টির কাছে মশলার দাম আলাদা নিতেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৭ বছর। চোখে অসুবিধার কারণে তিনি এখন আর মাছ ধরতে যান না। তবে মশলা তৈরি করে সাপ্লাই করেন। ৩১ মে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেদিন সকালবেলা মেটিয়াবুরুজ থেকে তিনজন লোক তাঁর কাছে মশলা কিনতে গিয়েছিল।
মাছ ধরা যে একটা শিল্প তা তিনি বহু জায়গায় প্রমাণ করেছেন। হলুদ গেঞ্জি আর সাদা হাফ প্যান্ট পরে মাছ ধরতেন জয়নাল খাঁ। ভয়ে তাঁর পাশে কেউ মাছ ধরতে চাইত না। একবার বড়তলা রেললাইনের নিকটবর্তী বিশাল পুকুর আদমার জলায় রীতিমতো সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জয়নাল খাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, নাম ছড়াবার জন্য আগে লোকে পুকুরে পাস দিত। এখন পুকুরে পাস দেওয়া হয় ব্যবসার জন্য, অনেকটা পেটের দায়ে লোক ঠকানোর জন্যও। এক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারও করা হয়ে থাকে।
একবার বিষ্ণুপুর মিশনের পুকুরে তৎকালীন গায়িকা-নায়িকা শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে তিনি মাছ ধরেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবন্তী দেবী ওঁকে ডেকে বললেন, ‘দেখুন তো চারে মাছ আছে? খাচ্ছে নাই বা কেন?’ জয়নাল খাঁ পনেরো মিনিটের মধ্যে দুটো পাঁচ কেজি ওজনের মাছ ধরে দিয়েছিলেন ওই চার থেকে। সেদিন দারুণ গর্ব হয়েছিল তাঁর। আজও সেকথা মনে আছে।
চারে কী মাছ রয়েছে, কতক্ষণ পর টোপ খাবে, কত বড়ো সাইজের মাছ, বলে দিতে পারতেন তিনি। টোপে স্ট্রোক দেওয়া দেখে তিনি মাছের জাত বলে দিতেন। অনেকে বলত, এটা যাদুমন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকী একবার সংগ্রামপুরে তাঁকে তাঁর প্রিয় হলুদ গেঞ্জি আর সাদা হাফপ্যান্ট খুলিয়ে শুধু গামছা পরে মাছ ধরতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে রোখা যায়নি। সেখানেও তিনি সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। শোয়ে মাছ ধরার ওস্তাদ ছিলেন। শোয়ে বলতে জলের সমান বহরে বড়ো ফাতনাকে শুইয়ে মাছ ধরা।
তাঁর কথায়, মশলা তৈরি করতে বেশ পরিশ্রম দরকার। খোল, একাঙ্কি, ঘোড়বন্ধ, আওবেল, ছোটো মেথি ১০০ গ্রাম করে নিয়ে লতাকস্তুরি ২০০ গ্রাম, ঘিয়ের গাদ ২ কেজি, এক কেজি মাখন গাদ, খাঁটি চোলাই ২০০ গ্রাম ইত্যাদি একসঙ্গে মেখে ফেলে গুঁড়ো করে জারে ভরে রোদ্দুরে রাখতে হবে। এই চার রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের জন্য। কিন্তু কাতলা মাছ ধরার স্পেশাল একটা মশলা আছে — ২০০ গ্রাম চালের ভাত পোলাও, ৫০০ গ্রাম ছাতু পোলাও, ১০০ গ্রাম ঘি, ১০ গ্রাম ছোটো এলাচ, ১০ গ্রাম জৈত্রি, ২০০ গ্রাম নারকেল তেল, খানিকটা মাখন গাদ দিয়ে চার তৈরি করা হলে ছিপে মাছ উঠবেই — প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলেন জয়নাল। এছাড়া কাতলা মাছের টোপে দুরকমের পোলাও কিছুটা নিয়ে রুটির টোপের সঙ্গে মিশিয়ে নরম করে ফেললে কাতলা আনন্দের সঙ্গে খাবে।
জয়নাল খাঁর একটা আফশোস থেকে গেছে। তিনি বিশাল বড়ো মাছ ধরতে পারেননি। তবে এক জায়গায় একই দিনে ২৪ কেজি ওজনের দু-দুটো কাতলা মাছ ধরার রেকর্ড ওঁর আছে। একদিনে তিনি ৫ মণ মাছও ধরেছেন। পাস পুকুরে অন্যদের চেয়ে পরে বসেও খুব কম হলেও ৬০-৭০ কেজি মাছ ধরেছেন।
Dipanjan Daw says
লতাকস্তুরি ,ঘোড়বন্ধ এর ছবি গুলি দেবেন প্লিজ।
Dipanjan Das says
দয়া করে ঘোড়বন্ধ,আওবেল এর ছবি দেবেন।