তপন চন্দ, মাদারিহাট, ৩০ জুলাই#
দুই বছরেরও বেশি আগে ২০১০ সালের ২৬ জুন মাদারিহাটের কিছু ব্যক্তি স্থানীয় একটি ব্যাঙ্কের শাখা-ম্যানেজারের বিরুদ্ধে এবং সেখানকার কিছু অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাঙ্কের জেড অফিস মুম্বইতে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। আমিও অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন। ২৮ জুলাই ২০১০ তারিখে পার্শ্ববর্তী ফালাকাটা ব্লকের অন্তর্গত জটেশ্বর শাখার ম্যানেজার তদন্তে আসেন মাদারিহাটে, সন্ধ্যের দিকে। তিনি অভিযোগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রত্যেককে তাদের লিখিত বক্তব্য জানাতে বলেন। সেই মতো কয়েকদিনের মধ্যে লিখিত বক্তব্য পেশ করা হয়।
অতঃপর ব্যাঙ্কিং অমবাডসম্যানের (লোকায়ুক্তের মতো, যে ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগের দেখাশোনা করে) তরফ থেকে অভিযোগকারী এক ব্যক্তির ডাক পড়ে, শিলিগুড়ির সেবক রোডের স্টেট ব্যাঙ্কের প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ে। দুজন অভিযোগকারী সেখানে গিয়েছিলাম, প্রতিবেদক এবং শিক্ষক গগনেন্দ্র নাথ রায়। সেখানে আমাদের বলা হয়, আপনাদের একাধিক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়েছে, আপনাদের অভিযোগ সঠিক এবং নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক ম্যানেজার তাঁর দোষ কবুল করেছেন। ফলশ্রুতিতে তাঁকে দুর্গম স্থানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে এবং বিভাগীয় একটি শাস্তি তাঁর হবে আর তা গোপন বলে আপনারা জানতে পারবেন না।
আমরা বিনীতভাবে জানাই, এই সামান্য বক্তব্যটি একটি পোস্টকার্ডে লিখে জানালেই হত। আলিপুরদুয়ার থেকে শিলিগুড়ি রেললাইনে রাজনৈতিক অবরোধ থাকায়, আমরা মাদারিহাট থেকে ফালাকাটা পর্যন্ত মোটর সাইকেলে এসেছি। তারপর বাসে শিলিগুড়ি, তারপর রিক্সা/অটো করে সেবক রোডের স্টেট ব্যাঙ্কের প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ে।
তখন আমাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়, তাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের হাত-পা বাঁধা, দোষী ম্যানেজারকে ফাঁসিতেও ঝোলাতে পারবেন না, শূলেও চড়াতে পারবেন না ইত্যাদি। আমরা গৃহীত ব্যবস্থায় সহমত পোষণ করলে বিষয়টির নিষ্পত্তি হল, এরূপ লিখে দিতে পারি, অন্যথায় তাঁদের আর কিছু করার নেই। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তদন্ত রিপোর্টই বা কী, তা লিখিত চাইলে ওঁরা বলেন, সেসব তাঁদের লিখে দিতে অসুবিধা আছে। যাই হোক, আমরা সহমত পোষণ না করায় ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসি। পরে বুঝেছিলাম, এইভাবে ডেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একের পর এক অভিযোগকারীদের কাছ থেকে ‘বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে, অতএব অভিযোগ প্রত্যাহার’, এরূপ লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ এক কায়দা!
‘গোপন তথ্য, দেওয়া যাবে না’
এবার আসি তথ্যের অধিকার আইন নিয়ে লড়াইতে। এই বিষয় নিয়ে ওই ২০১০ সালেরই ৭ জুলাই সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার জটেশ্বর শাখার তথ্য আধিকারিকের কাছে আবেদন করি কিছু তথ্য পাওয়ার জন্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খামটি ফেরত আসে। খামের ওপর ডাকঘরের মন্তব্য, এইরকম কোনো ঠিকানা নেই, তাই ফিরিয়ে দেওয়া হল। এটিতে তথ্য অধিকার আইন ২০০৫-এর ধারা/উপধারাকে অমান্য করা হয়েছে এবং আমার অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনে অভিযোগ জানাই। তথ্য কমিশন আমাকে সত্ত্বর ণ্ণ১ম আবেদন’ এবং তাতে কাজ না হলে ‘২য় আবেদন’ করতে বলে। যাই হোক, আমি প্রামাণ্য তথ্য সহযোগে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর ণ্ণ১ম আবেদন’ করি। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কলকাতার আঞ্চলিক অফিস থেকে আমার কাছে ২৮ জানুয়ারি ২০১১ লেখা একটা চিঠিতে জানায়, যে সমস্ত তথ্য আমি চাইছি, তা প্রকৃতি অনুযায়ী গোপন এবং তথ্যের অধিকার আইনের ৮ (১)(ডি) এবং (ই) অনুসারে তা মকুবযোগ্য এবং আমার আবেদন কোনো জনস্বার্থ বিষয়ে নয়। কাজেই তারা তথ্য দিতে অপারগ।
২৩ মার্চ ২০১১ তারিখে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের আমার প্রশ্নের উত্তরে তথ্য দিতে নির্দেশ দেয়, প্রয়োজনে শুনানি করে হলেও। এছাড়া কেন যথা সময়ে তথ্য দেওয়া হয়নি তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জানাতে বলে, যাতে কমিশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের ওপর। এছাড়া আমাকে প্রয়োজন হলে ণ্ণ২য় আবেদন’ করতে বলে। আমি তাই করি, ৩০ এপ্রিল ২০১১ তারিখে।
এরপর একবছর কেটে যায়।
অতঃপর ভিডিও কনফারেন্স
এ বছরের ২৭ এপ্রিল কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন আমার অভিযোগের ভিত্তিতে ভিডিও কনফারেন্সের জন্য নোটিশ দেয়, যা সংঘটিত হয় ২২ মে ২০১২ তারিখে। আবেদনকারী হিসেবে আমি ছিলাম জলপাইগুড়ির কালেক্টরেট বিল্ডিংয়ের তথ্য কমিশনের জেলা অফিসে। ব্যাঙ্কের জন তথ্য আধিকারিক ছিলেন কলকাতার অফিসে। ভিডিও কনফারেন্স হয় ৫-৭ মিনিট। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে সম্মত হয়। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন আদেশ করে, পনেরো দিনের মধ্যেই যেন বিনামূল্যে আমাকে আমার চাওয়া তথ্য দেওয়া হয়।
১১ জুন ২০১২ তারিখে আমাকে ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে তথ্য দেওয়া হয়। কিন্তু অসমাপ্ত সে তথ্য। তার মধ্যে আছে ওই ব্যাঙ্কের জটেশ্বর ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের তদন্ত রিপোর্টের প্রত্যয়িত কপি, ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক ম্যানেজারের ণ্ণগোপনীয়’ লেখা চিঠি। কিন্তু এই তথ্যে আমি সন্তুষ্ট নই, কারণ, অভিযোগগুলির কপি দেওয়া হয়নি। এছাড়া, মোট এগারোজন অভিযোগকারীর মধ্যে আটজন, যাঁরা অভিযোগ প্রত্যাহার করেছেন, তাঁদের নাম আছে তদন্ত রিপোর্টে। কিন্তু যে তিনজন, এই প্রতিবেদক, গগনেন্দ্র নাথ রায় এবং চিন্ময়ী রায়, যাঁরা অভিযোগ প্রত্যাহার করেননি, তাঁদের নাম তদন্ত রিপোর্টে নেই।
অসমাপ্ত রিপোর্টে আমি সন্তুষ্ট না হওয়ায় আপাতত ফের তথ্য কমিশনের দ্বারস্থ হচ্ছি এবং ভিডিও কনফারেন্সের সিডি চাইছি। কিন্তু, দেরিতে হলেও, অসমাপ্ত হলেও, তথ্য অধিকার আইনের ব্যবহার করে আমি কিছু তথ্য পেয়েছি। এটা তথ্যের অধিকার আন্দোলনের একটি জয়। আমরা প্রত্যেকে একটি দেশলাই কিনলেও কর দিই। সেই করের টাকাতেই দেশ চলে। তাই তথ্য দিতে সরকার বাহাদুর বাধ্য।
Leave a Reply