সমাজকর্মী কৃষ্ণা রায়ের সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন শমীক সরকার, ২৭ ডিসেম্বর#
ধর্ষণের ঘটনা কি বাড়ছে?
সেটা বলা খুব মুশকিল। তবে রাস্তাঘাটে বাড়ছে বলেই আমার মনে হয়। ধর্ষণের জায়গা বিস্তৃত হয়েছে। এই যে দিল্লিতে বাসের মধ্যে ঘটনা, গাড়ির মধ্যে ঘনঘন ঘটনা — এগুলো আগে তো শোনা যায়নি। বা ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে যে ঘটনা কাটোয়াতে ঘটেছে, সেদিক থেকে দেখলে রাস্তাঘাটে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে আমার মনে হয়।
কারণ?
” |
আমার ছোটোবেলায় আমি আমার মাকেও প্রশ্ন করেছিলাম, সন্ধ্যে হওয়ার আগে আমাকে ঘরে ফিরতে হবে। কেন? কারণ সন্ধ্যে হওয়ার পরে মেয়েদের ঘরে ফিরতে হয়, কারণ রাস্তায় দুষ্টু লোকেরা ঘুরে বেড়ায়। আমার প্রশ্ন ছিল, আমি কেন ঘরে ফিরব? দুষ্টু লোকেদের তোমরা বন্দী কর। এই জায়গাটা আরও বেশি করে সামনে আসছে। |
কারণ সম্পর্কে ওইভাবে বলা মুশকিল, তবে সার্বিকভাবে হিংসা বাড়ছে, সমাজ অনেক বেশি হিংসাত্মক হয়ে গেছে। ফলে যার যেখানে ক্ষমতা প্রদর্শন করার জায়গা আছে, সেখানে করছে।… মেয়েরা এখন বাইরে বেরোচ্ছে অনেক বেশি বেশি করে, মেয়েদের আর ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না … আমি সেগুলোর জন্যই ধর্ষণ হচ্ছে তা বলছি না, কিন্তু পাবলিক প্লেস এ ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার এগুলোও কারণ। আর এর প্রতিকার কখনওই এটা হতে পারে না, যে মেয়েদের আবার ঘরের মধ্যে আটকে রাখো। বরং সমাজের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এবং তার দায় গোটা সমাজের। এই যে আগে বাচ্চাদের খুব মারপিট করা হত। এখন ধীরে ধীরে সমালোচনা হয়ে হয়ে তা অনেক কমেছে। বাচ্চাদের গায়ে এখন চট করে তো হাত তোলে না। আগে তো খুব তোলা হত। চারদিক থেকে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে। এইভাবেই মূল্যবোধ তৈরি করা দরকার। শুধুমাত্র পরিবার, বাবা, মা-এর দায়িত্ব তা নয়। সমাজ, সমাজের বিভিন্ন চক্র, যে চক্রগুলোর মধ্যে আমরা ঘুরি। পাঠ্যক্রমে আসাটা কিন্তু খুব দরকার। একদম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটা। মেয়েদের সম্মান করা। মেয়েদের অসম্মানের জায়গা থেকে না দেখা।
দিল্লির ক্ষেত্রে আমি যতদূর জানি, মেয়েরা কিছু কিছু জায়গায় বেরোতোই না সন্ধ্যের পর। এখন সেসব উপেক্ষা করছে। মানছে না। সেটাও একটা ব্যাপার। অনেক বেশি মেয়েরা বাইরে। অনেক রাতে বেরোচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের কাজে বেরোচ্ছে। নাইট শিফট-এ কাজে যাচ্ছে। আইটি সেক্টরে করছে কাজ। এটাও একটা কারণ, মেয়েরা মানছে না। ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকা, রাত বিরেতে বেরোবো না, সেটা মানছে না। অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে। সেটাও একটা কারণ বলে আমার মনে হয়। মেয়েদের তো আগে এত রাতে দেখা যেত না। দিল্লিতে যেমন কথাই ছিল, পাবলিক বাসে মেয়েরা ট্রাভেল করে না, রাত্রিবেলা বেরোয় না। একটু সন্ধ্যে হয়ে গেলে আর বেরোয় না। সেগুলো ঘটছে না, সেটাও একটা কারণ। তবে কারণ বলতে যেন ভুল না বুঝি আমরা। তাহলে কি মেয়েরা ঘরের মধ্যে থাকবে? এটা কিন্তু খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। মেয়েরা বেরোনোটাই কারণ, তা নয়। আমি যেটা বলতে চাইছি, আগে মেয়েরা ভয়টা পেয়ে মেনে নিত। এখন সেটা তারা আর মানছে না। বলছে, দিন রাত, চব্বিশ ঘন্টা আমাদের কাজ করতে হবে। বেরোবো আমরা। এটা ঘটতে পারে বলে, দুষ্কৃতিরা কিছু দুষ্কর্ম করতে পারে বলে আমি ঘরে বসে থাকব, সেটা হতে পারে না। এটা তো মেয়েদের অ্যাটিচুড হয়ে গেছে। যে আমি কেন বন্দী থাকব? আমার ছোটোবেলায় আমি আমার মাকেও প্রশ্ন করেছিলাম, সন্ধ্যে হওয়ার আগে আমাকে ঘরে ফিরতে হবে। কেন? কারণ সন্ধ্যে হওয়ার পরে মেয়েদের ঘরে ফিরতে হয়, কারণ রাস্তায় দুষ্টু লোকেরা ঘুরে বেড়ায়। আমার প্রশ্ন ছিল, আমি কেন ঘরে ফিরব? দুষ্টু লোকেদের তোমরা বন্দী কর। এই জায়গাটা আরও বেশি করে সামনে আসছে।
দিল্লির ঘটনার পরে দিল্লিতে কমবয়েসী মেয়েরা যেভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে …
প্রচুর ছেলেরাও এসেছে প্রতিবাদে। আমার কাছে সেটা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। মেয়েদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, মেয়েরা তো আসবেই। কিন্তু ছেলেরাও দলে দলে এসেছে। আমি খুব বেশি স্টাডি করতে পারিনি এই বিষইয়টা, কিন্তু আমার যেটা মনে হচ্ছে, ঘটনা ঘটতে ঘটতে একটা যেকোনও ঘটনা স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। প্রথমত পাবলিক বাস-এ হয়েছে, অতটা রাতও নয়, মাত্র ন’টা। পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় যে অজুহাতগুলো ছিল, অত রাত, মদ্যপান — যেগুলো না করা হলে বোধহয় ধর্ষণটা ঘটত না, এটাতে দেখা যাচ্ছে রাত ন’টার সময়, একজন সঙ্গীর সাথে বেরোচ্ছে, পাবলিক বাসের মধ্যে হচ্ছে — ফলে কোনও অজুহাতই খাড়া করা যাচ্ছে না। এটা একটা উত্তুঙ্গ ঘটনা ঘটে গেছে।
কিন্তু এই প্রতিবাদটা তো দেখাচ্ছে যে মেয়েরা কোনওভাবেই ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে রাজি নয়। কোনওভাবেই আর পেছন ফিরতে রাজি নয়। এবং সমাজও তাকে ঘরে সেঁধিয়ে যাওয়ার ডাক দিতে রাজি নয়, তাই ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে প্রতিবাদটা হচ্ছে। বিশেষ করে কমবয়সীরা আরও রাজি নয়।
হ্যাঁ, আর প্রটেকশনের তত্ত্ব মানতে রাজি নয় কেউ।
কিন্তু আবার ফাঁসির কথাটাও উঠছে একই সাথে। কড়া সাজার কথা উঠছে।
আমি এর ঘোরতর বিরোধী। মৃত্যুদণ্ডের তো ঘোরতর বিরোধী বটেই। আর এই কড়া শাস্তি, এরও বিরোধী। আমরা বহুদিন ধরেই বন্ধুবান্ধবরা বলছি, যারা শুরু থেকেই এইসব ইস্যু নিয়ে কাজ করছিলাম। তার কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে এই সব কড়া শাস্তি চাইব কেন? রাষ্ট্র এই ইস্যুগুলোকে বোঝার জায়গাতেই নেই। সে এগুলোকে আরও বিভিন্নভাবে বাড়াচ্ছে। সেই জায়গাগুলোতে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্রের কাছে এটা চাইতে যাব কিসের জন্য? সেটা তো আইনি হিংসা। একটা মানুষের জীবন নিয়ে নেওয়া — সে দাবি কখনওই আমরা করতে পারিনা। এটা একদম ঠিক না। কোনও ক্ষেত্রেই ঠিক না। এটা একটা দিক। নীতিগত দিক। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধটাকে রোধ করা যায় না। যেমন খুন। খুন কি বন্ধ হয়েছে? খুনের শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড আছে এখনও পর্যন্ত। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, যেসব দেশে মৃত্যুদন্ড এখনও চালু আছে, সেদেশেও তো খুনের ঘটনার কিছু কমতি নেই। মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া দরকার। কেন সে হিংসা টা করছে সেই মূল্যবোধের জায়গাটাতে আঘাত না করে তার গলাটাকে কেটে নিলাম, এতে কিচ্ছু হবে না। এতে আরও বেশি ভয়ানক হবে। আরও বেশি যেটা ঘটবে সেটা হচ্ছে, প্রমাণ লোপ করার জন্য আরও বেশি বেশি করে মেয়েদের মারবে। রেপ করবে, তারপর মারবে। আরও বাড়বে এই ঘটনা।
তাছাড়া রাষ্ট্রের কাছে আমরা যে কড়া শাস্তির দাবি করছি, রাষ্ট্র কিন্তু খুবই একপেশে। বিশেষত শ্রেণীগতভাবে। ওপরতলার লোক করলে ছাড়, নিচুতলার লোক করলে ছাড় নেই। এছাড়াও তার আমলাতন্ত্রের লোক যদি করে এইসব, সেসব জায়গাতে কিন্তু রাষ্ট্র বলো বা কোর্ট বল, যে ধরণের ভূমিকা নেয়, সেগুলো আমাদের খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। যখন রাষ্ট্রের নিজের প্রতিনিধি, যারা এই নিয়ম বা আইনগুলো বলবৎ করবে, এই মূল্যবোধগুলো প্রচার করবে, যাদের কাছে আমরা আশা করছি, তারা যখন ভায়োলেট করে সেগুলো পাবলিকলি … রূপান বাজাজকে যখন পি এস গিল (বড়ো পুলিশ অফিসার) ওইরকম যৌন হেনস্থা করেছিল তখন সারাক্ষণ আমলাতন্ত্র বলো, কোর্ট বলো, সবাই বলছে, সামান্য পেছনে থাপ্পড় মারার জন্য তার শাস্তি দাবি করা বাতুলতা। এই যে প্রটেকশন দিয়ে যাচ্ছে — তো তাদের কাছে আমরা কী দাবি করব? যে দুর্বল শ্রেণীর লোকজনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সুবিধা হয়, সেখানে খুব জোরে আওয়াজ তোলা হয়। এখানে দিল্লিতে যেমন যারা অপরাধ করেছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বতর শ্রেণীর মানুষ। সেখানে কিন্তু ফাঁসির দাবি তুলতে সুবিধে হয়। কিন্তু যখন ক্ষমতাশালী লোকেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, যেমন সোনি সোরিকে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে অঙ্কিত গর্গ-এর বিরুদ্ধে, তখন কিন্তু কড়া শাস্তির দাবি ওঠে না। কেউ তুললেও রাষ্ট্র সেগুলোকে সারাক্ষণ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাইকোর্টে বলা হচ্ছে, বারবার রূপান বাজাজের ওপর চাপ দেওয়া হয়েছে, যাতে সে কেস তুলে নেয়। গিল গোপনে ক্ষমা চেয়ে নেবে। মেনে নাও। কেন এসব দাবি করছ? শাস্তি তো ছেড়েই দিলাম। সাত বছর লেগেছিল হাইকোর্টকে কেসটা নিতে রাজি করাতে। সেইখানে কার কাছে দাবি করব আমরা? আজ এইসব ধর্ষণের ঘটনার জন্য বহুলাংশে রাষ্ট্র নিজে দায়ী।
সমাধান কি?
” |
সমান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে ছেলে মেয়ে উভয়কেই বড়ো করা দরকার। এগুলো কীভাবে স্কুলপাঠ্যে ঢোকানো যায়, কীভাবে কলেজ পাঠ্যে ঢোকানো যায়…। এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। রাষ্ট্রের কাছে ফাঁসি চাইলাম, কড়া শাস্তি চাইলাম, তা নয়। |
এত সহজে সমাধান নেই। মূলত হচ্ছে মূল্যবোধের পরিবর্তন করতে হবে। সমাজে হিংসা কমা দরকার। মেয়েদের সম্মানের জায়গাটাতে আসা দরকার। মেয়েদের দেহকে ঘিরে যে শুচিতার মূল্যবোধ চালু আছে, সেটাকেই তো এক্সপ্লয়েট করা হচ্ছে। তা নাহলে হাত কাটছে না, পা কাটছে না, দুম করে বসে বসে রেপ করছে কেন? কারণ, রেপ করলে পরে আমারও একটা শক্তি প্রদর্শন হল, আর ওরও জীবনটা গেল। এটার সাথে যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই। যৌন আনন্দ, বা কোনওরকম কিছুর সম্পর্ক নেই। এক হচ্ছে শক্তি প্রদর্শন, দুই হচ্ছে প্রতিহিংসা। বহু ক্ষেত্রেই স্রেফ প্রতিহিংসার জন্য… পারিবারিক প্রতিহিংসা, জাতিগত প্রতিহিংসা এই সমস্ত মেটানোর জন্য মেয়েদের ওপর রেপ করা হচ্ছে। এইগুলোর বিলোপ হওয়া দরকার। এই ধরণের রাজনীতি, এই ধরনের মূল্যবোধ বিলোপ হওয়া দরকার। এবং সমান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে ছেলে মেয়ে উভয়কেই বড়ো করা দরকার। এটা সবার দায়িত্ব আছে। এগুলো কীভাবে স্কুলপাঠ্যে ঢোকানো যায়, কীভাবে কলেজ পাঠ্যে ঢোকানো যায়…। এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। আমরা এই সব পাঠ্যে কিন্তু শক্তিপ্রদর্শনের শিক্ষাগুলোই পাই। তার বদলে সেখানে এই শক্তি প্রদর্শনের বিরোধিতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসারের দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে ফাঁসি চাইলাম, কড়া শাস্তি চাইলাম, তা নয়। রাষ্ট্রের কাছে এই দায়িত্বগুলো যাতে সে পালন করে তার দাবি তোলা দরকার। বাবা মায়ের কাছে ছেলেমেয়েরা কতক্ষণ থাকে? আর বাবা নায়ের কথা সে কতক্ষণ শোনে?
” |
মেয়েদের ওপর কলঙ্ক চেপে আছে, একবার যদি কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হয়, তাহলে তার সামাজিক মৃত্যু। বলা হয়, তার মরে যাওয়া ভালো ছিল। এই জায়গাটা কিন্তু মেয়েদেরও সরাতে হবে, সমাজকেও সরাতে হবে। এটা সরাতে পারলে কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা কমে যাবে। |
দ্বিতীয়ত, আমরা এতক্ষন রাস্তাঘাটে ধর্ষণ ও যৌনহিংসা নিয়ে কথা বলছি। পরিবারের মধ্যে যখন হচ্ছে, তখন? প্রচুর ঘটনা আছে, যেগুলো বাইরে আসে না। নিজের যেখানে কর্তৃত্ব রয়েছে, এমনকি নিজের বাবা, সৎ বাবা, দাদা, কাকা — এরা দিনের পর দিন বাড়ির মধ্যে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। বাইরে আসছে না কিছুই। আসার কোনও উপায় থাকে না। সেই জায়গাগুলো খুব কঠিন মোকাবিলা করা। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেরিয়ে আসার মতো কোনও জায়গা নেই। আজ যদি বাবা করে, দাদা করে, মা-কে বলছে। মা ক্ষমতাহীন সেখানে। মেয়েরা যাবে কোথায়? বলতে পারে না। দিনের পর দিন এগুলোকে মুখ বুঁজে সহ্য করে। এই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে প্রচুর আসে। কিন্তু সে কোথায় যাবে সেটা তো বলতে পারিনা। কারণ পুলিশের কাছে যদি মেয়েটা বাবার নামে বলে, তবে মেয়েটা যাবে কোথায়? তারপর যে পুরো অবস্থাটা হবে, সে সেটা ভাবতে পারে না। চুপচাপ সহ্য করে। দাদার ক্ষেত্রেও তাই হয়। মা বলে, চুপ করে থাক। সত্যি সত্যি আমরা জানি না কিন্তু কীভাবে এগুলোর আশু মোকাবিলা করা সম্ভব।
রাস্তাঘাটে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিকারের বড়ো উপায় হচ্ছে এর কলঙ্কটাকে সরানো। এই যে মেয়েদের ওপর কলঙ্ক চেপে আছে, একবার যদি কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হয়, তাহলে তার সামাজিক মৃত্যু। বলা হয়, তার মরে যাওয়া ভালো ছিল। তার হাত চলে যাওয়া অনেক ভালো ছিল, পা কেটে নেওয়া অনেক ভালো ছিল, রেপড হয়ে বেঁচে থাকার থেকে। এই জায়গাটা কিন্তু মেয়েদেরও সরাতে হবে, সমাজকেও সরাতে হবে। এটা সরাতে পারলে কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা কমে যাবে। কারণ মূল জায়গাটা থাকে প্রতিহিংসা, ক্ষমতা প্রদর্শন, সামাজিকভাবে মেরে ফেলা। যদি ধর্ষণের সাথে জড়ানো কলঙ্কটাকে বিলোপ করা যায়, তাহলে ধর্ষণের কারণগুলির ধার অনেকটাই কমে যাবে।
নতুন যে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ আইন, যেটা এখনও লাগু হয়নি, তাতে তো ফাঁসির সাজার কথা নেই।
” |
শাস্তি হতে হবে সৃজনশীল, যাতে একইসঙ্গে শাস্তিও হয়, আবার পরিবর্তনও হয়। |
কিছু কড়া শাস্তির কথা ওখানেও আছে। আমি কিন্তু কোনওদিনই কড়া শাস্তির পক্ষে সওয়াল করিনি। আমরা আইনগতভাবে দাবি করি, আগে দোষী প্রমাণ হোক। সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারপর তার শাস্তি হোক ছোটোখাটো। অন্য ধরণের শাস্তি দেওয়া হোক বরং। যাতে তার পরিবর্তন হয়। শাস্তি মানে জেলের মধ্যে ফেলে রেখে দাও, এই ধারণারই আমি বিরোধী। এমনকি জেলেরও তো নাম সংশোধনাগার। তা যদি আমি তার একটা কড়া শাস্তি দিয়ে তার নাক কান কেটে নিলাম, গলা কেটে নিলাম। সে বাঁচলোই না, তাতে আর সংশোধনটা হবে কী করে? শাস্তি হতে হবে সৃজনশীল, যাতে একইসঙ্গে শাস্তিও হয়, আবার পরিবর্তনও হয়। যদি কড়া শাস্তি দিই, তাহলে তার মধ্যে যে নরম অনুভূতিগুলো আছে, সেগুলো আরও নষ্ঠ হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক অনুভূতিগুলো কড়া শাস্তি দিয়ে বাড়ানো যায় না। কিভাবে সেগুলো বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা দরকার। তাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানে কড়া শাস্তি নয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে যে শাস্তি তার পরিবর্তন আনে।
উদাহরণ?
উদাহরণ বলতে যেখানে উন্মুক্ত জেল আছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও আছে। খুন করেছে, যাবজ্জীবন হয়েছে। প্রথম অপরাধ, কিন্তু সেটাই খুন। তাকে জেল থেকে যেটা করছে, উন্মুক্ত জেল, জেলের মধ্যেই পরিবার নিয়ে থাকছে। স্ত্রী থাকছে, বাবা-মা থাকছে, বাচ্চারাও থাকছে। তাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে বাইরে গিয়ে কাজ করার। তার একটা বড়ো ট্রাকের ব্যবসা ছিল, বালি তুলত। কন্ট্রাক্ট পায়নি, যার ওপর নির্ভর করে কাজটা করছিল, তাকে ঠাস করে জোরে চড় মেরেছে, সে অসুস্থ ছিল, মারা গেছে। লোকটি কিন্তু ভীষণ আপশোস করছে। এটা বুঝতে পেরে তাকে কিন্তু উন্মুক্ত জেল-এ আনা হয়েছে, পরিবার সন্তানদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হচ্ছে। সে বাইরেও বেরোচ্ছে, দশটায় বেরোচ্ছে, ছটায় ঢুকে পড়ছে। এটা করলে কী হচ্ছে? তার প্রতি বিশ্বাস করা হল, মানুষের প্রতি যে সহজ বিশ্বাস সেটা ফিরিয়ে আনা হল। যে তুমি একটা সহজ জীবনে যেতে পারো। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাথরের দেওয়ালের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিয়ে মানুষকে তো পরিবর্তন করা যায়না। এখন সে বলছে, আমি এই নিয়মগুলো ভাঙবো না, আমি জানি, যে মুহুর্তে আমি এক মিনিট দেরি করে ঢুকবো, আমার এই সুযোগগুলো চলে যাবে। ওই উন্মুক্ত জেল-এ অনেকেই কিন্তু বাইরে এসে পানবিড়ির দোকানও দিয়েছে, চায়ের দোকান দিয়েছে। ঠিক ছটার সময় আবার ঢুকে যাচ্ছে। আমি এটা দেখেছি। এখানে হচ্ছে। ফলে শাস্তি কিন্তু এইভাবেই ভাবা উচিত, যে মানুষকে যাতে পরিবর্তন করা যায়।
আরও কিছু কিছু আছে, যেমন একজন শিশু-নির্যাতনকারীকে দেওয়া হয়েছিল, যে গিটার শেখাত। বিদেশে কোথাও একটা জায়গার ঘটনা। তার বাড়ির সামনে এটা লিখে দিয়েছিল, এত বছরের জন্য এর কাছে কেউ বাচ্চাকে পাঠাবেন না। তার পরিবর্তন দরকার। কারণ সে এই কাজ করেছে। এবং একইসঙ্গে তাকে কিছু কাউন্সেলিং-এর কোর্স দেওয়া হচ্ছিল। … এই প্রচেষ্টাগুলো চলছে।
পশ্চিমবঙ্গে রাস্তাঘাটে ধর্ষণ এবং অন্যান্য অপরাধ কমানোর জন্য একটা সিস্টেম চালু করা হচ্ছে, অ্যাডভান্স ট্র্যাকিং সিস্টেম। যেটাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্যামেরায় ছবি তোলা হতে থাকবে। এবং ছবিতে কিছু এদিক ওদিক ডিজিটাল লজিক-এ ধরা পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে কাছের যে পুলিশ স্টেশন সেখানে অ্যালার্ট যাবে এবং সেখানকার পুলিশ অফিসার সেই ছবি লাইভ দেখবে ও ব্যবস্থা নেবে। এটা একটা অপরাধ নিবারণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বলা হচ্ছে। এর কি কোনও উপযোগিতা আছে?
না। আমি এগুলোর প্রচণ্ড বিরোধী। এই সারভাইলেন্স-এর প্রচণ্ড বিরোধী। এতে সমস্ত মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট হবে। বিশ্বাসের জায়গাটাতে হস্তক্ষেপ করার চেষতা করা হচ্ছে। আমার হাঁটা চলা সবকিছু পুলিশের কাছে চলে যাবে। এটা একদম কাঙ্খিত পদক্ষেপ নয়। অন্যভাবে ভাবা উচিত। এটা কতটা বাস্তবোচিত সে নিয়েও সন্দেহ আছে।
কৃষ্ণা রায় সমাজকর্মী, পাঠ্যপুস্তকে ভারসাম্যের অভাব নিয়ে নিয়ে তার প্রকাশিত পুস্তিকা, ণ্ণখোকা যাবে শিকার, খুকু যাবে শ্বশুরঘর’।
Leave a Reply