শমীক সরকার, কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি#
দিল্লি ম্যানিফেস্টো
দিল্লি ম্যানিফেস্টো কীভাবে তৈরি হল? আম আদমি পার্টির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় — ‘দিল্লির সমস্যাগুলোকে বোঝার জন্য এবং নাগরিকদের আশা আকাঙ্খার হদিশ পাওয়ার জন্য আম আদমি পার্টি একটি সামগ্রিক সমীক্ষা, দিল্লি ডায়লগ শুরু করেছিল। এই সমীক্ষা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে দিল্লি নিয়ে একটা শক্তপোক্ত, বাস্তব এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আমাদের ইস্তাহার কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত উৎপাদন নয়। শত শত বিশেষজ্ঞর সাক্ষাৎকার, হাজার হাজার নাগরিক সভা এবং লক্ষ লক্ষ সমীক্ষাপত্রের উত্তর, অনলাইন মন্তব্য, ইমেল সাজেশন, প্রজেক্ট প্রস্তাব এবং আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার এবং ফেসবুক মন্তব্য — এইসবের সংশ্লেষ ঘটিয়ে এই ইস্তাহারটি তৈরি হয়েছে। …’
জল
ইস্তাহারে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে জল এবং বিদ্যুৎ। জল নিয়ে প্রথমে দিল্লির সামগ্রিক অবস্থাটি বলা হয়েছে — বর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৪০ শতাংশ ঘরে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহ হয় না (এবং ঠিকঠাক নিকাশি ব্যবস্থা নেই), ফলে জলের ট্যাঙ্কার, টিউবওয়েল, কুয়োর মাধ্যমে জল পায় তারা। এদিকে দিল্লির বেশ কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলস্তরের অবস্থা বড়ো করুণ। কিছু কিছু এলাকায় জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা ভয়ানক — ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন বন্ধ, নিকাশি হয়ে আসা জল পরিশোধনের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার ও ভূগর্ভস্থ জল সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। এদিকে দিল্লি জল বোর্ড দুর্নীতি ও অব্যবস্থার জন্য প্রচুর উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়। গত দশ বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও দিল্লির জল ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এরপরই আপ বলছে, তারা জলকে খাদ্যের মতোই একটি মৌলিক অধিকার বলে মনে করে। তাই প্রত্যেক বাড়ি, মহল্লা, বাসস্থানের জন্য সমানভাবে জলের সরবরাহ সরকারের দায়িত্ব; বৃষ্টির জল পুনরুদ্ধার, সমস্ত জায়গায় বৃষ্টির জল ধরার বন্দোবস্ত ইত্যাদি। মাসে ২০ কিলোলিটার জল (মানে দিনে ৫০ বালতি) মুফতে, এটা ‘জীবনদায়ী জল’। সমস্ত মহল্লা, বস্তি, অ্যাপার্টমেন্ট — জলের পাইপলাইন ও নিকাশি, তিনটি জায়গায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, যমুনা নদীকে দূষণ মুক্ত করা, দূষিত জল যমুনায় মেশা বন্ধে করা ব্যবস্থা। সমস্ত কলোনি এবং বসতিতে নিকাশি জল পুনর্ব্যবহারের জন্য পরিশোধনের বন্দোবস্ত। জলের ট্যাঙ্কার মাফিয়ারাজ খতম ইত্যাদি। সমগ্র দিল্লি পাইপলাইনের মধ্যে আনা পাঁচ বছরের মধ্যে। হরিয়ানার মুনাক ক্যানেল থেকে জল আনার বন্দোবস্ত পাকা করা। ‘জীবনদায়ী জল’-এর চেয়ে বেশি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবদিক বিবেচনা করে জলের দাম নির্ধারণ করা এবং প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে জলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রদ। ছোটো দোকানপাটের (<১০০ বর্গফুট) জন্য বাণিজ্যিক হারে জলের দাম বাতিল করা। জলের গুণমান ঠিক রাখায় নজরদারি, জল ব্যবহারের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্মাণ, জল লিক বন্ধ করা, দিল্লি জল বোর্ডের বেসরকারিকরনের প্রস্তাবের বিরোধিতা। নলকূপ নিয়ন্ত্রণ, পুকুরের পুনরুজ্জীবন। মহল্লা সভার জল-স্বরাজ সমিতিই জল সরবরাহ, বৃষ্টির জল ধরা ইত্যাদি দেখভাল করবে। উল্লেখ্য, দিল্লির জল ব্যবস্থা নিয়ে তারা একটি পৃথক শ্বেতপত্রও প্রকাশ করে।
বিদ্যুৎ
দিল্লির বিদ্যুৎ নিয়েও আপ একটি পৃথক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে।
দিল্লির বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ‘দিল্লি ট্র্যান্সকো’ নামে সরকারি সংস্থা এবং অনেকগুলো প্রাইভেট ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিসকম)। ট্র্যান্সকো-কে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দেয়নি ডিসকমগুলো। ডিসকমগুলো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং নিজেদের সংস্থাগুলোর কাছ থেকে জিনিসপত্র কেনে বেশি দামে। এসব কোনো কিছুরই অডিট হয় না কখনও। এটা একটা বড়ো দুর্নীতি। যেমন, দিল্লি বিজেপির চিফ সতীশ উপাধ্যায় দিল্লির ডিসকমগুলো থেকে বরাত পেয়েছে মিটার সাপ্লাই দেওয়ার। ডিসকমগুলো ২০১২ সালে ৬৩০ কোটি টাকা লস দেখিয়েছে। কিন্তু পরে অডিট করে দেখা যায়, তারা আসলে লাভ করেছে ৩৫৭৭ কোটি টাকা। দুর্নীতির মাত্রাটা এই রকম! কিন্তু অডিট করলেও দিল্লি ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি অথরিটি ডিসকমগুলোকে কোনো শাস্তি দেয়নি। গত তিনবছর ধরে ডিসকমগুলো বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে, তারপর নিজেদের ‘সিস্টার কনসার্ন’কে কম দামে বিক্রি করে লস দেখাচ্ছে। প্রাইভেটাইজেশনকে সমাধান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হলেও গত দশ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ।
এরপর আপ বলেছে, তারা দিল্লির বিদ্যুৎ বিল পঞ্চাশ ভাগ কমাতে চায়, যাতে ডিসকমগুলোর শোষণ থেকে মানুষ কিছুটা উদ্ধার পায়। এই ভরতুকি যাবে ট্র্যান্সকোর পকেটে, কিন্তু কিছুতেই ডিসকমগুলোর পকেটে নয়। দিল্লির ডিসকমগুলোর ক্যাগ অডিট করানো হবে (যা ৪৯ দিনের সরকার আদেশ দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখনও করা হয়নি)। দিল্লিতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং রাজঘাট ও বাওয়ানা বিদ্যুৎকেন্দ্র দু-টি ভালোভাবে চালানো। প্রসঙ্গত, দশ বছর আগেও দিল্লিতে বিদ্যুৎ উদবৃত্ত ছিল। কিন্তু গত দশ বছরে দিল্লির বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন কমে গেছে তিরিশ শতাংশ। তাই এখন বিদ্যুৎ বাইরে থেকে কিনতে হয়। আপ এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে নাগরিক বেছে নিতে পারে, কোন ডিসকম থেকে বিদ্যুৎ নেবে। ফলে ডিসকমগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে বিদ্যুতের বিল কমানোর জন্য। এখন এই ব্যবস্থা নেই। ঘরে ও বসতিতে সৌরবিদ্যুৎ চালু করার প্রস্তাব এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দিল্লির বিদ্যুতের চাহিদার ২০ শতাংশ মেটাবে সৌরবিদ্যুৎ — এই ঘোষণা। ভরতুকি দেওয়া হবে সৌরবিদ্যুতে।
Leave a Reply