২৫ অক্টোবর, জগাছা, হাওড়া, সংবাদমন্থন প্রতিবেদন#
হাওড়া শহরাঞ্চলের ব্যস্ততম রামরাজাতলা রেলস্টেশন থেকে মিনিট চার-পাঁচ হাঁটাপথে পড়ে ষষ্ঠীতলা-মণ্ডলপাড়ার সংযোগস্থল। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের পাশেই ওই মোড়ে রয়েছে গুণধর সামন্তের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। তার প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে মহাবীর অ্যাপার্টমেন্ট। সামনেই রয়েছে বহু পুরোনো ২০ কাঠার একটি জলাশয়। ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাটি হাওড়া পৌরসভার ৪৮নং ওয়ার্ডের জগাছা থানার মধ্যে পড়ে। এখানে রয়েছে ছোটো ছোটো কারখানা, তিন-চারটি বহুতল আবাস। মাঝে এই জলাশয়টি ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহৃত একটি নির্ভরযোগ্য পুকুর। এর বাঁধানো ঘাট বহন করে চলেছে অসংখ্য মানুষের পদচিহ্ন। জলাশয়ে খেলা করত মাছের দল।
২০১১ সালের ৩০-৩১ আগস্ট তৎকালীন বাম জমানার ষষ্ঠীতলা, ধর্মতলা, খাঁয়েরবাগান এলাকার অসংখ্য পুকুর ভরাটের নায়ক রঞ্জিত পাল ওরফে মেজকা দলবল নিয়ে হাজির হয় ওখানে। দু-তিনদিনের মধ্যে বাঁশ পুঁতে ওই জলাশয়টিকে নতুন টিন দিয়ে ঘিরে ফেলে। এর সাবেক দাগ নং হল ১৪২৩, মৌজা সাঁতরাগাছি, জে এল নং ৪।
‘সামাজিক’ সন্ত্রাসের ভয়ে যখন সাধারণ মানুষ ইষৎ প্রতিবাদ করে চুপ করেই রইল, তখন শিবপুরের ‘পরিবেশপ্রেমী নাগরিকবৃন্দ’ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ একটি লিখিত অভিযোগ করল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তার প্রতিলিপি পাঠানো হল পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার সহ হাওড়ার মেয়র, পুলিশ কমিশনার, মৎস্য দপ্তরের আধিকারিক, ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক, শিবপুরের বিধায়ক, ৪৮ নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা, জগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের কাছে।
অভিযোগপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শনবাবু তৎপরতার সাথে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বিভাগের আইজি-কে একটি নির্দেশ জারি করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন সরেজমিন তদন্ত করে পুকুরটির চারপাশে লাগানো টিনগুলো খুলে দেয়।
কিন্তু মেজকার হুমকিতে কেউ আর পুকুরের ধারে যায় না। যেসব জেলেরা ওই জলাশয়ে মাছ চাষ করত, তারাও সব বেপাত্তা হয়ে যায়। ফলে অব্যবহৃত জলাশয়টি হয়ে ওঠে কচুরি পানার খেত। পাশের ছোট্ট বস্তির কয়েকজন কচুরি পানা সাফ করতে গেলে তাদের বলা হয় — ‘এটা কি তোদের বাপের পুকুর?’ সঙ্গে জোটে কিছু চড়-থাপ্পড়। ফলে পুকুরটির বাঁধানো স্নানের ঘাট এখন সর্বত্র ঝোপঝাড় আগাছায় পরিপূর্ণ।
প্রাক্তন ডিএসপি গোপাল মশাটের জামাই উজ্জ্বল হত্যা সহ অসংখ্য খুনের জন্য অভিযুক্ত মেজকা সর্বত্র তদ্বির করছে, ‘পুকুরটা কেউ ব্যবহার করছে না, দূষণ ছড়াচ্ছে। আমাকে ভরাট করতে দেওয়া হোক।’
পুকুরটাকে সংরক্ষণ করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আর একটি ভয়ঙ্কর চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের সামনে উঠে আসে।
আদালতে জীবন্ত জলাশয় হয়ে যায় ঘর সহ বাস্তু
২০১১ সালের ১৮ আগস্ট। স্থান : হাওড়া জেলা রিজিস্ট্রি অফিস। সেখানে এই টলটলে জল ভর্তি জীবন্ত জলাশয়কে (৩৩ শতক) কাগজে কলমে চার টুকরো করা হয়। প্রতি টুকরোয় ১০০ বর্গ ফুট টালির ঘর এবং কমন প্যাসেজ সহ চারটি প্লটকে রিজিস্ট্রি করা হয়। শুধু তাই নয় অস্তিত্ববিহীন কল্পিত প্লটগুলির ডিড প্ল্যানগুলি হাওড়া পৌরসভার পরতিনিধির কাছ থেকে ‘তারিখবিহীন’ স্বাক্ষরে সিলমোহর সহ মঞ্জুর করা হয়েছে।
অস্তিত্ববিহীন কল্পিত প্লটগুলির ক্রেতাগণ
১। রঞ্জিত পাল, পিতা (প্রয়াত) জয়দেব পাল, কামারডাঙ্গা, শীতলাতলা, হাওড়া।
২। দেবব্রত পাত্র, পিতা (প্রয়াত) লালমোহন পাত্র, পল্লবপুকুর, কালীতলা, হাওড়া।
৩। রবীন দাস, পিতা (প্রয়াত) সহদেব দাস, খাঁয়েরবাগান, সাঁতরাগাছি, হাওড়া।
৪। প্রসেনজিত খাঁ, পিতা (প্রয়াত) বিনয়ভূষণ খাঁ, বালিটিকুরী, শেঠপাড়া, হাওড়া।
অস্তিত্ববিহীন কল্পিত প্লটগুলির বিক্রেতাগণ
১। সূর্য শেঠ, পিতা (প্রয়াত) অমরেন্দ্রনাথ শেঠ, ষষ্ঠীতলা, সাঁতরাগাছি, হাওড়া।
১। শুকদেব শেঠ, পিতা (প্রয়াত) অমরেন্দ্রনাথ শেঠ, ষষ্ঠীতলা, সাঁতরাগাছি, হাওড়া।
আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি এক বিঘা জলাশয়কে হত্যা করে চারটি প্লটে ঘর সহ বাস্তু হিসেবে দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা রাজ্যের ভূমি আইন, পৌর আইন ১৯৯৩, পুকুরে মৎস্য চাষ সংশোধিত আইন ১৯৯৩ সহ যাবতীয় আইনি ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যারা এই কাজে লিপ্ত, তাদের ওপর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
Leave a Reply