জিতেন নন্দী, বঙ্গাইগাঁও, ১৬ সেপ্টেম্বর#
গুয়াহাটি থেকে বঙ্গাইগাঁও নয়দিনের সফরের পর আজ আমরা কলকাতা ফেরার অপেক্ষায়। নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনের রিটায়ারিং রুম থেকে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। গত কয়েকদিন আমরা বড়োল্যান্ড স্বশাসিত অঞ্চলের তিনটি জেলায় ঘুরেছি — কোকরাঝাড়, চিরাং, বঙ্গাইগাঁও। কেবল উদালগুড়ি জেলায় আমাদের যাওয়া হয়নি। শরণার্থীদের শিবিরে শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে বড্ডো অসহায় লাগছিল। মহিলারা নিজের ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসার বৃত্তান্ত বলতে বলতে কেঁদে ফেলছিল। শেষের দিকে চিরাংয়ের কাউয়াটিকা গ্রামে একজনের মুখে তাঁর নিজের ছেলে এবং মামাতো ভাইয়ের কোতল হওয়ার খবর শুনে আমাদেরই পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল। শিবির পরিদর্শনের এমন বিড়ম্বনা সহ্য করা মুশকিল।
শেষদিন তাই আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবেই বেরিয়ে পড়লাম। হেঁটে হেঁটে গেলাম শান্তিপাড়া, ঝিলকাঝাড় পর্যন্ত। বিস্তীর্ণ সবুজের বুকে ছোটো ছোটো গ্রাম। দূরে পাহাড়ের সারি। আজ দিনটাই মেঘলা। ঝিলকাঝাড় রাজবংশী অধ্যুষিত গ্রাম। এর পরেই ডাংতল গ্রাম, সেখানে আছে বড়োরা। মুসলমানরা এখন সেখানে যেতে ভয় পায়। মাঝে নতুনপাড়া। সেখানে রয়েছে দুনিয়াপাহাড় শ্মশান। হাঁটতে হাঁটতে শান্তিপাড়া থেকে ফেরার সময় দেখলাম কাঠের চুল্লিতে শব দাহ করা হচ্ছে।
স্থানীয় মুসলমানরা এই শ্মশানকে হিন্দুদের বলেই জানে। কিন্তু একটু খোঁজ করে জানলাম, এই শ্মশানে কোচ, রাজবংশী, সাঁওতাল, হিন্দু বাঙালি সকলেরই দাহ হয়। কাছারি, নাথ সম্প্রদায়ের মধ্যে শিবগোত্রের মানুষেরও দাহ হয়।
আমরা যাওয়া-আসার পথে দু-বারই একটা চায়ের দোকানে বসে লম্বা আড্ডা মারলাম। লাল চা খেতে খেতে কথা হল বহু মানুষের সঙ্গে। এখানে সবাই বাঙালি মুসলমান। তাদের মুখে মিষ্টি বাঙাল ভাষা। চায়ের দোকানি মধ্যবয়স্ক মানুষ, নাম আবদুল মজিদ। লাগোয়া ঘরে ওঁর বউ, ছেলে আর ছোট্ট মেয়েও রয়েছে। মজিদ বললেন, আগে তিনি নাকি সর্দারি করতেন। সর্দারি মানে সাব-কন্ট্রাক্টারি। এখন চায়ের দোকান আর কিছু জমি অন্য বাঙালি হিন্দুর কাছ থেকে নিয়ে চাষ করেন। শুধু এটুকুই নয়, বললেন, ‘আরও ব্যবসা আছে’।
কীসের ব্যবসা? ভেঙে বললেন না। সকালে যাওয়ার সময় একজন মানুষ মজিদের দোকানের সামনে মোটরবাইক রেখে গরু খুঁজছিলেন। সকলকে জিজ্ঞাসা করতে করতে দেখলাম শান্তিপাড়া গ্রামে গিয়ে সেই গরু উদ্ধার হল। গরুটাকে টেনে নিয়ে আসা হল। আমি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কুরবানির গরু নাকি?’ তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘কিছু ঠিক নেই’।
আমরা যখন ফিরছি, ওই চায়ের দোকানেই একজন যুবক এসে ওই গরু কেনার জন্য মোটরবাইক আরোহীর সঙ্গে দর কষাকষি করছিলেন। এগারো হাজার থেকে নামতে নামতে পাঁচ হাজার দুশো পর্যন্ত নামলেন গরুর মালিক। আমরা অন্য আলাপে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে দেখলাম, মোটরবাইক স্টার্ট দিয়ে লোকটি চলে গেলেন। যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হল, রফা হল না?’ তিনি বললেন, ‘পাঁচ হাজার একশো টাকা দিচ্ছিলাম, উনি রাজি হলেন না। আসলে একজনের বাড়িতে বিয়ে আছে, গরুটা লাগত।’ এর আগে লক্ষ্য করলাম, দোকানদার মজিদ আমাদের সামনে গরুর এই দরাদরি পছন্দ করছিলেন না। সেটা প্রকাশ করাতে গরুর মালিক বেশ রেগে গিয়েছিলেন।
মজিদ এবং দোকানের অন্য খদ্দেররা বলছিলেন, এবার মাঠে শালিধানের ফলন ভালো হয়েছে। শালিধান মানে আমাদের চেনা ধান আমন। এখানেও অধিক ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার আর ওষুধের ব্যবহার একইরকম রয়েছে। মজিদ অধিক ফলনশীল রঞ্জিত বীজের পাশাপাশি দেশি বীজও অল্প লাগিয়েছে। তাতে ফলন কম। তাঁর আশা, রঞ্জিত বীজে বিঘাপ্রতি দশ-বারো মণ ধান হবে। এখানে চায়না বীজ নামে একটা বিদেশি ভ্যারাইটি আছে। মজিদ বলেন, ‘ঠিক মতো করতে পারলে ওর ফলন বিশ মণ।’
বহু চাষের জমি ফাঁকাও পড়ে রয়েছে। চাষ হয়নি। মজুর খাটার লোক পাওয়া যায় না। মাঠে ১২০ টাকা মজুরি, সেখানে টাউনে খাটতে গেলে ২০০ টাকা পাওয়া যায়।
বড়োদের পাড়ায় মুসলমানদের এখন যাতায়াত নেই। জুলাই মাসে দাঙ্গার পর থেকে এই অবস্থা চলছে। এখনও নাকি বড়োদের পাড়ায় মুসলমান লেবারদের কাজ দেওয়া হচ্ছে না। মুসলমান মানেই এখন ‘বাংলাদেশি’। চতুর্দিকে পোস্টার পড়েছে, ‘বাংলাদেশিদের কাজ দিলে দশ হাজার টাকা ফাইন’।
মজিদ বলছিলেন, বড়োদের খাওয়ার কোনো বিচার নেই। ওরা রাক্ষস, সব খায়। পোকামাকড়, এমনকী দাঁড়াস সাপ পর্যন্ত খায়। ওদের মধ্যে অনেকেই চাষের কাজ জানে না। হালবলদ করতে চায় না। ধান যদিও বা লাগায়, সবজি চাষ একদম জানে না। আড্ডায় অন্যরাও যোগ দেয়। জানা যায়, বড়োরা মারা গেলে মুখাগ্নি করে নদীর তীরবর্তী জায়গায় পুঁতে দেওয়া হয়। মুসলমানেরা গোরস্থানে মাটি খুঁড়ে ঘর তৈরি করে কবর দেয়। বড়ো খ্রিস্টানরাও কবর দেয়। কোচ রাজবংশীরা পোড়ায়। রাভারা মাটিতে পুঁতে দেয়। সাঁওতালদের রীতি এরা জানে না।
কোকরাঝাড়ে রুইসুমোই হোটেলে আমরা দেখেছি, খাসি মুরগি আর শুয়োরের মাংস পাওয়া যায়। তবে ডিম পাওয়া যায় না। যাই হোক, খাদ্যাভাসের এসব ফারাক তো জাতিতে জাতিতে বরাবরই ছিল। কিন্তু এমন তীব্র সংঘাত ছিল না।
এখন মজিদদের চোখে বড়োদের অনেক কিছুই খারাপ। বড়ো বা মুসলমান সকলের মনেই দাঙ্গার ঘা এখনও দগদগে। পাশাপাশি বাস করা দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন একটা স্পষ্ট ফাটল। অথচ তাঁরা এটাও বললেন, জুলাই মাসের আগে তাঁদের মধ্যে একসঙ্গে ওঠাবসা খাওয়াদাওয়া সবই ছিল।
Leave a Reply