অমিতাভ সেন, ভবানীপুর, ৯ জানুয়ারি#
বাড়ির গেটের উল্টোদিকে রঙের দোকান। ট্রানজিস্টরে মান্না হেমন্তের গান। দীপ ছিল, শিখা ছিল — কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না। দোকানদারের ভাগনে ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর শাল মুড়ি দিয়ে গানের সাথে গলা মেলাচ্ছে। বেসুরো গলা আজ চমৎকার খেলছে — এমন কাঁপুনি যে কষ্ট করে গলা কাঁপাতে হচ্ছে না। বেলা তিনটেয় রেডিওর খবর — শৈত্যপ্রবাহ আরও তিনদিন চলবে।
ওপাশের ঘরে ঘটঘট ঠঙ ঠঙ হাতা ও হাঁড়ির সংঘাতে খিচুড়ি। এ ঘরেও তাই, কিন্তু গরম খিচুড়ি খেয়েও শীত কমছে না। হাত পা কালিয়ে আসছে। চান না করার জন্য? তাহলে যে চান করেছে তারও কেন এক অবস্থা? সবাই লেপ খুঁজছে। এক ফোঁটা রোদ নেই। সূর্যের মুখ দেখা যায়নি সারাদিন। দরজা খুলে নিরঞ্জন মিস্ত্রি যন্তরের ব্যাগ মেঝেতে নামিয়ে বলল, আমাদের ওখানে এর দ্বিগুণ ঠান্ডা দাদা। সকালে হেঁটে স্টেশনে আসতে দেখি, হাতের পাতা এমন জমে গেছে যে খোলা হাত মুঠো করতে পারছি না। নিরঞ্জন মিস্ত্রি আসেন ঘুটিয়ারি শরিফের কাছে বেদবেড়িয়া থেকে। আজ কাল মেলেনি ছুতোরের কাজ। একজন বৃদ্ধ খবর দিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন আগে। আজ নিরঞ্জন গিয়ে দেখেন যে সে বুড়ো ভদ্রলোকই মারা গিয়েছেন দুদিন আগে। আজ তাঁর মরদেহ শ্মশানে নিয়ে গেল। মেয়ে আমেরিকা থেকে ফেরার অপেক্ষায় সেই ভদ্রলোকের শব তিন দিন ঠান্ডাঘরে রাখা ছিল। নিরঞ্জন মিস্ত্রি খালি হাতে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে দ্রুত চলে গেলেন। এর মধ্যে এক সাইক্লিস্ট দাদা ফোন করেছিলেন। ঝাড়গ্রাম থেকে আমাদের এক বন্ধুর দিদি এসেছেন, তাঁর ভাজকে নিয়ে। আকুপাঙচার করে প্যারালিসিস সারাবেন। রামরিক হাসপাতালে তিনতলায় চার নম্বর বেডে ভর্তি হয়েছেন। নাম পুতুল দলুই। চাদর টাদর মুড়ি দিয়ে বের হলাম। রাস্তায় পাড়ার বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সেও হনহন করে ওদিকেই চলেছে। হাসপাতালের উল্টোদিকে ফুটপাথে তার দোকান। জামাকাপড় বিক্রি করে সে। ফুটপাথের ওপর প্লাস্টিকে ঢেলে। বলল, কার কাছে টুপির স্টক আছে সেই খোঁজে চলেছে। ওর স্টক শেষ, গতকাল একদিনে আট ডজন টুপি বিক্রি করেছে। এত টুপি বিক্রি হয়ে যাবে বুঝতেই পারেনি।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখি কেউ কোত্থাও নেই। ডাক্তার-নার্স-কর্মচারি। ঠান্ডায় কে যে কোথায় জমে গেছে? ছোটো হাসপাতাল। আমি গটগট করে তিনতলায় গিয়ে দেখি মহিলা ওয়ার্ডের একটা ঘর ধানকাটা মাঠের মতো ফাঁকা। বারোটা বেডের একটায় রোগিনী ননদকে শুইয়ে ভাতৃবধূ আরেকটায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওই রোগিনী পুতুল দলুই। আমি তাঁকে আগে চিনতাম না। উনি খালি হাসছেন। কথা বলতে পারছেন না। শুনলাম, ডাক্তারবাবু ভালো — বলেছেন সব সেরে যাবে। ওঁরা ভরসা পেয়েছেন শুনে আমিও ভরসা পেলাম। কিন্তু হাসপাতালের রকমসকম দেখে মনটা খচখচ করছে। ওঁরা মানিয়ে নিচ্ছেন বেশ সহজেই। ভাইবউ লোহার বেডে চটের থলিতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন — তাঁর কোলের মধ্যে ঢুকে একটা বেড়াল কাঁদছে। উনি বললেন, বেড়ালটার শীত করছে, তাই। কিছু দরকার হলে বলবেন, বলে ফিরে এলাম। কী কী দরকার মেটাতে পারব, তা কিন্তু জানি না।
হাসপাতালের নিচে এসে দেখি, কর্মচারীদের কাউকেই চিনতে পারছি না। টুপি মাফলার চাদরে কারও মুখ বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাসপাতালের গেটে আগুন জ্বালিয়ে যারা হাত সেঁকছিল তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম। ওই হাসপাতালেই কাজ করে, তাকে বলে এলাম, বন্ধুর দিদিকে একটু দেখতে। সে বলল, ডিউটির যা চাপ যাচ্ছে দাদা, তিনদিন পুরো নির্জলা কেটেছে। বলেই সে হাঁটা লাগালো পাশের গলির দিকে। পাশের গলিতে বিলাতী মদের দোকানে তখন লাইন বাড়ছে। আর গলির মুখে বাড়ছে চপের দোকানের উনুন ঘিরে কুকুরের ভিড়। সবকটার লেজ দু-পায়ের মাঝে গুটিয়ে গেছে। বিশ্রি কুয়াশা এসে কলকাতাকে লন্ডন বানাচ্ছে।
Leave a Reply