আখতার হোসেন, হাজিরতন, মেটিয়াব্রুজ, ২২ আগস্ট#
নুরুল হুদার বাড়ি ছিল বড়তলার কানখুলি রোডে। সকলে ওঁদের গাইড ড্রেসেস নামে চেনে। আমাদের চেয়ে অনেক কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেলেন তিনি। একেবারে প্রচারবিমুখ এই মানুষটি খুব গোপনে নীরবে এত মানুষের উপকার করেছেন, তা বলার নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, বড়তলা গার্লস স্কুল এবং বড়তলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন এবং আরও অনেক ব্যাপারে অকুণ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেছেন। ওঁদের আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত, যেমন পতাকা গোষ্ঠীর মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে ওঁর মেজোমেয়ের শ্বশুরবাড়ির তরফে আত্মীয়তা। বড়োমেয়ের জামাই ডাক্তার করীম সন্তোষপুরে জনপ্রিয় চিকিৎসক। আমি ওই বড়োমেয়েকে পড়াতাম।
কোনো রাজনীতিওয়ালারা ওঁর কাছে পাত্তা পায়নি, কাউকে প্রশ্রয় দেননি। আমায় বলত, ‘আখতারদা কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, আমার করণীয় আমি করছি।’ ১৯৬৮ সাল, বড়তলা গার্লস স্কুল তৈরি হবে, একটা লোক বলেছিল রড মিস্ত্রি সব দেবে। হঠাৎ সে বেঁকে বসল, আগে টাকা দিতে হবে। আমাদের তো মাথায় হাত! নুরুদ্দীন, ওঁর খালাতো ভাই, ওঁকে বলল, ‘নুরুল পয়সা দে দাও।’ নুরুল বললেন, ‘হয়ে যাবে’। আমরা ভাবছি, চাঁদা-টাঁদা তুলব। তার আগে দুদিনেই চাঁদা আদায় হয়ে গেল। আর একবার আমাদের স্কুলে ৬০টা পাখা দিয়েছিলেন।
ওঁর বাবার বিশ্বাস ছিল, লেখাপড়া করে কিছু হবে না। তাঁর বড়ো আর মেজোছেলে লেখাপড়া করে খুব সুবিধা করতে পারল না। সেজোছেলে নুরুল লেখাপড়ার দিকে না গিয়ে দারুণ ফুলের (এমব্রয়ডারি) কারিগর হলেন। সেইসময় ঠিক করে ফেললেন, ব্যবসা করবেন। ওঁকে পছন্দ করে ফেলল মারোয়াড়িরা, একে ব্যাক করা যাক। এক বছরের মধ্যে বাড়িতে প্রচুর খদ্দের আসা শুরু হয়ে গেল। সেইসময় থেকে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। এখানে প্রথম ফ্যাশন ড্রেসের প্রবর্তন এঁরাই করেন। তিনি নিজে ছিলেন দক্ষ কারিগর। ফ্যাশন টেকনোলজিতে ওস্তাদ, এককভাবে অন্য জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখন ওই লাইনে অন্য কেউ নেই।
আমার নিজের ঘর যখন করলাম, আমার এক পয়সা ছিল না। আমার পাশে এসে দাঁড়াল সুজা, ইউনুস, আলতাফ আর এই নুরুল হুদা। ১৯৯৮ সালে সেই ঘরে এলাম।
নুরুল হুদা মারা গেছেন ঈদের আগের মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট। একজন আমাকে বলছিলেন, ‘আখতার স্যার আপনি কি জানেন, ঈদের সময় বহু লোকের কান্নাকাটি হবে।’ আমি বললাম, ‘কীসের জন্য?’ — ‘নুরুল হুদা যে চলে গেলেন!’ এই যে আমাদের তথাকথিত জাকাত দেওয়া, ফেতরা ইত্যাদি পালন হয় বেশ ঘটা করে। না, ও করত একেবারে নীরবে। এই সময় কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যেত বহু মানুষের জন্য। আমাকে স্কুলের ব্যাপারে বলতেন, নামটাম দেবেন না আখতারদা।
আমি বা গোলাম রসুল, আমরা জানি ওর অবদান। কিন্তু আমরা তো চলে যাব। যারা জানে না, তাদের কাছে ওর কথা জানানো দরকার। ওর জানাজায় প্রচুর মারোয়াড়ি এসেছে, কবরেও মাটি দিয়েছে অনেকে। আমি যখন ওর বড়োমেয়েকে পড়াতাম, একদিন এসে বলল, ‘দেখুন তো, এটা আপনার গায়ে হয় কিনা?’ একটা হালকা ওজনের দামি সোয়েটার নিয়ে এসে বলে, ‘চোখে পড়ল বলে কিনে নিয়ে এলাম। এখান থেকে পরে যান।’ তারপর একদিন লাইব্রেরিতে বসে আছি, একটা টুপি নিয়ে এসে বলল, ‘দেখুন তো এটা পছন্দ হয় কিনা?’ আমাদের বাঁচিয়ে রাখার একটা উদ্দেশ্য ছিল ওর মনে। বলত, ‘আপনারা না থাকলে এই স্কুল হত না।’ আমি মনে মনে বলতাম, ‘তোরা না থাকলে কি এই স্কুল হত?’ নুরুল হুদা ছিল দর্জিসমাজের আপনজন।
Leave a Reply