অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৪ জুলাই#
তালতলা লেনের শুরুর দিকটায় অন্ধকার আর পেচ্ছাপের তীব্র গন্ধ। গলিটার থেকে ইউটার্ন নিয়ে বেরিয়ে এস এন ব্যানার্জি রোডে পড়ার আগে ত্রিপুরাশঙ্কর সেন শাস্ত্রী স্মৃতি লাইব্রেরি। সেখান থেকে খবরের কাগজের দু-চারজন পাঠক ঝুঁকে আকাশ দেখল। বৃষ্টি নামল। মেঘের তো কমতি নেই, বৃষ্টি কতক্ষণ হয় কে জানে। আষাঢ়ের অর্ধেক পেরিয়ে গেল। এখনও বর্ষা জমল না। একজন বৃদ্ধ পাঠক আরেকজনকে বলেন, ‘পলিউশন, বুঝলেন পলিউশনেই সব শেষ হয়ে গেল। আমরাই আমাদের সর্বনাশ করে ছেড়েছি। বর্ষা হবে কোথা থেকে?’
এই বৃদ্ধর মতোই এপাড়ায় এখনও এমন কতকগুলো বাড়ি বেঁচে আছে, যাদের ঝুল বারান্দার লোহার রেলিঙে ফুল আর লতাপাতার কারুকাজ। মোড়ের মাথায় একদিকে দেবদারু আর অন্যদিকের গাছটা সম্ভবত জারুল। একজন দেহাতি বয়স্ক লোক আমাকে বললেন, ওটা জঙ্গল গাছ, ছোটাসা ফল ভী হয়। আমি সেই আধচেনা গাছের নিচে ছাতা হাতে দাঁড়িয়েছি। টিউশনি বাড়ির দরজা তালাবন্ধ। সন্ধ্যে ৭টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। সময় কাটাতে সামনের ফুটপাথের চায়ের দোকান থেকে একটা চা নিলাম। চারিদিকে দেখছি। উল্টোফুটে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের চাঁদোয়ার নিচে ভুট্টাওয়ালা আগুন বাঁচিয়ে রাখতে এত দ্রুত হাতপাখা নাড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে একটা বড়ো প্রজাপতি যেন তার হাতের মুঠোয় স্থির হয়ে আছে। আমার ফুটে চায়ের দোকানের পাশে নিচু রকে হিন্দুস্থানি খেটেখাওয়া মানুষের ভিড়। তাদের মাথার ওপর টাঙানো কালো প্লাস্টিকে বৃষ্টির জল জমে সাদা সাদা মোটা ধারায় নেমে আসছে। ওরকম মোটাধারার ডোরাকাটা পটে লুঙ্গি আর ফতুয়া বা গেঞ্জি গায়ে মানুষগুলোর হাতে হাতে চা আর খইনি। আবছা আলোছায়ায় কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে লাল গামছা কাঁধে একজনের সাদা গোঁফের তলা থেকে অদ্ভুত দেহাতি সুর ভেসে এল। সেই দেহাতি লোকগানে মেঘমল্লারের সুর না থাকলেও মেজাজটা আছে। বাঁদিকে আমার পায়ের কাছে সেই জঙ্গল গাছ থেকে ক-হাত মাত্র দূরে, ইলেকট্রিক পোস্টের নিচে আবর্জনার স্তূপ। সেখানে একটা ভাঙ্গা বাইক ভিজছে। নম্বর প্লেটে লেখা আছে, কলকাতা পুলিশের বাইক তাও লেখা আছে। লাল মাটগার্ডের ফোকলা চাকাদুটো এমনভাবে নোংরার ঢিপির মধ্যে হাঁটুগেড়ে বসে আছে, মনে হচ্ছে মহাভারতের কর্ণের রথের চাকা — রথচক্র গ্রাসিছে মেদিনী। দেখতে দেখতেই বৃষ্টির বল্লম উঠিয়ে আকাশের যোদ্ধারা হাওয়া। আমিও আমার ছাতার ঢালটা গুটিয়ে নিয়ে টিউশনি বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম।
Leave a Reply