২৭ অক্টোবর, সুমতি এবং তার বন্ধুরা দিল্লির ত্রিলোকপুরী এলাকায় যায় পরিস্থিতি এখন কেমন তা দেখতে। তার একটি অসম্পূর্ণ দলিল সুমতি প্রকাশ করে তার ফেসবুক পরিসরে। এখানে তারই বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো। সাবহেডিং অনুবাদকের। অনুবাদ করেছেন শমীক সরকার। পূর্ণাঙ্গ তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্টটি পরে প্রকাশিত হবে। #
… তখন ওখানে ১৪৪ চলছিল এবং ২-৩ জনের বেশি একসাথে চলতে পারছিল না রাস্তায়। রাস্তাঘাট ছিল শুনশান, এবং সমস্ত দোকান বন্ধ। এলাকা জুড়ে ছিল পুলিশ এবং র্যাফ। এই ত্রিলোকপুরী এলাকাটি গরীব শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি, যাদের মধ্যে রয়েছে দলিত এবং মুসলিম।
‘হাম কসম খাতে হে কি বিজেপি কো হি ভোট দেঙ্গে’
এলাকায় ব্লক নং ২০, ২১, ৩৩ সহ বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু দলিত বসতিগুলোতে কথা বলে দেখা গেল, দলিতদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী ক্ষোভ তীব্র, যার বেশিরভাগই হয়ত গুজব এবং প্রচারযন্ত্রগুলোর বদান্যতায় চালু ধারনাগুলোর সমন্বয়ে তৈরি। অনেকেই বলছিল, ণ্ণমাতা কি চৌকির কাছে মুসলিমরা মূত্রত্যাগ করেছে, আমাদের পুজোর কাছে ওরা মাংস ছুঁড়েছে, আমাদের মেয়েদের ওরা হয়রানি করেছে, ওরা সবসময় এই এলাকা পাকিস্তান বানিয়ে দেবে বলে ভয় দেখায়’ ইত্যাদি কথা। কিন্তু কেউই এসব কাউকে করতে দেখেছে বলে মনে হলো না। ২১ নং ব্লকের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়, আমরা দেখলাম, স্থানীয় বিজেপি নেতা সুনীল ভৈদ (যিনি গত দিল্লি নির্বাচনে আম আদমি পার্টির প্রার্থীর কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন) এর অফিস। ওই অফিসের কাছে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা বুঝলাম, ভেতরে একটা মিটিং চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৫-২০ জন ছেলে-ছোকরা এসে আমাদের সঙ্গে উত্তেজিত স্বরে কথাবার্তা বলতে শুরু করে দিল। দরজায় একজন পুলিশ ছাড়াও আরো একজন ছিল, যাকে দেখে মনে হলো সুনীল ভৈদ স্বয়ং। বাইরে একজন একটা গেরুয়া পট্টি মাথায় জড়িয়ে কি একটা ভিডিও রেকর্ডিং করছিল। আমরা যখন একটু কাছে এগিয়ে গেলাম কি হচ্ছে দেখার জন্য, দেখলাম ভিডিও-তে বিজেপির হয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে, ণ্ণহাম কসম খাতে হে কি বিজেপি কো হি ভোট দেঙ্গে’। এরই মধ্যে যে মহিলাটির সঙ্গে আমরা কথা বলছিলাম, তিনি বিজেপি যে এই দাঙ্গায় মদত দিয়েছে তার অভিযোগ অস্বীকার করলেন এবং নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্যও যে এই কাজ করা হয়েছে, তাও মানলেন না। তিনি সম্পূর্ণ দায় চাপালেন মুসলিমদের ঘাড়ে। আমরা এরপর ২৮ নং ব্লকের দিকে এগোলাম, যেখানে হিন্দু মুসলিম জনগণ পাশাপাশি থাকে। দু’জন হিন্দু বসতির যুবকের গুলি লেগেছে এখানে যখন পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।
২৭ নং ব্লকে কেবল কার্ফু
পুলিশ আমাদের সকলকে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে তল্লাশি করছিল, কিন্তু এই গলিগুলোতে ঢুকতে বাধা দেয়নি। কিন্তু আমরা যখন মুসলিম অধ্যুষিত ২৭ নং ব্লকে ঢুকতে গেলাম, তারা বাধা দিল। ওই ব্লকে কার্ফু জারি রয়েছে, কারণ মুসলিমদের দুটি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং লোকে তার জন্য পুলিশকেই দায়ী করছে। আমরা দু-জন মেয়ে, আমাদের ২৭ নম্বর ব্লকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। আমরা বিভিন্ন কোণা দিয়ে চেষ্টা করলাম, ঢুকে পড়লাম কিছুটা। বেশিরভাগ মানুষই কম রোজগারের। হয়ত দৈনিক মজুরিতে খাটে (মিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি) বা অটো চালায় বা ছোটো ব্যবসা-দোকান রয়েছে। ২৭ নম্বর ব্লকের আমাদের বন্ধুরা যারা কথা বলেছে, তাদের কাছ থেকে জানলাম, নয়ডার পোশাক কারখানায় এখানকার অনেকে কাজ করে। একইভাবে অন্যান্য ব্লকের হিন্দু অধিবাসীদের বেশিরভাগই দলিত বাল্মিকী সমাজের এবং মেথরের কাজ করে। আমরা কিছু মহিলার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললাম। তারা বর্ণনা করল, কীভাবে ২৪ অক্টোবর রাত্রে ২৭ নং ব্লকটিকে আক্রমণ করা হয়েছিল ইঁট, পাথর ও বোতল নিয়ে। আক্রমণকারীদের কেউ কেউ চিৎকার করছিল, ণ্ণহর হর মহাদেব’। যদিও এই ব্লকের বাসিন্দাদের ২০ নং ব্লকে দেওয়ালির রাত্রে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, তবুও তাদের আক্রমণ করা হয়েছিল। মহিলারা আমাদের বলল, তারা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ এসেছে দু-ঘন্টা পরে। এসে মূলত দাঁড়িয়ে দেখেছে, যখন পাথর ছোঁড়া হচ্ছিল। সারাদিন ধরে এটা চলেছে।
‘এই পুলিশ পুরোপুরি একতরফা’
নাজরিন নামে এক মধ্যবয়স্ক মহিলার দুই ছেলেকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। ছোটো ছেলেটা দুধ কিনতে বাইরে গিয়েছিল, তখনই তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় জোর করে। যখন নাজরিন থানায় গেল তার বড়ো ছেলেকে নিয়ে, বড়ো ছেলেকেও ধরে নিল পুলিশ। নাজরিনকে ছেলেদের খাবারটুকুও দিতে দিল না। কিন্তু নাজরিন জানালো, ণ্ণহিন্দু মায়েদের কিন্তু ছেলেদের খাবার দিতে দেওয়া হয়েছে’। নাজরিন আমাদের সামনে অনেকবার কেঁদে উঠল কথা বলতে বলতে। যদিও তার ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতে পেরেছে, কিন্তু সে বারবার আমাদের কেঁদে কেঁদে বোঝাচ্ছিল, কীভাবে তার সামনেই ছেলেদুটোকে পিটিয়েছে পুলিশ। মহিলারা বারবার আমাদের বলছিল, ‘পুলিশ যদি জনগণেরই হবে, তো সে তো হিন্দু মুসলমান সবার জন্যই হবে। কিন্তু এই পুলিশ পুরোপুরি একতরফা। এই ঝামেলায় লোকেদের থেকেও বেশি দোষী পুলিশ এবং নেতারা’। একজন মহিলা বললেন, কীভাবে ২৭ নং ব্লকের হিন্দু ও মুসলিম মহিলারা দাঙ্গাকারীদের ২৪ তারিখ রাতে জোরহাত করে থামতে বলেছে। আমাদের সামনেই কিছু মুসলিম পরিবার ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেল।
দলিত হিন্দুদের মধ্যে জমা হওয়া মুসলিম বিদ্বেষ জমি তৈরি করেছে
এলাকার বেশিরভাগ মানুষই বলল, এখানে গত ক’বছর সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েন ছিল না, যদিও প্রত্যেকের মধ্যেই ১৯৮৪ সালের দাঙ্গার স্মৃতি আজও রয়েছে। বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার নিঃসন্দেহে এই টানাপোড়েনে পুরোপুরি উস্কানি দিয়েছে এবং পরিকল্পনা করেছে, যা বহুদিন ধরে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিমদের প্রতি জমা হওয়া ক্ষোভের জমিতে ফসল তুলেছে। এতে বিজেপি আসন্ন নির্বাচনে লাভবানও হবে। আমরা যত বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রত্যেকে বলেছে, আম আদমি পার্টির নির্বাচিত এমএলএ একবারের জন্যও এলাকায় আসেনি। বাসিন্দারা মুদিখানা, দুধ, ওষুধপত্র কিনতে পারছে না বা দিনমজুরির কাজে বাইরে যেতে পারছে না। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেঙে যাওয়া বন্ধনের মাটি এবার হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে মদত জোগাবে।
Leave a Reply