শাকিল মহিনউদ্দিন, মেটিয়াব্রুজ, ৫ জুলাই (ব্যাঙ্ক বা ব্যক্তিদের নাম অপ্রয়োজনীয় বলে দেওয়া হয়নি)#
অসহায় পেনশনারের দুর্ভোগ
জীর্ণ শরীরটায় হাড় আর মাংসের শত্রুতা, কোনোরকমে পেশিসুতো দিয়ে ট্যাগ করা। ঢিলেঢালা চামড়া নেমে যেতে যায়, তারা জানান দেয় লোকটার বয়স পঁচাত্তর থেকে আশির মধ্যে। চশমার ভেতরে মৃতপ্রায় চোখদুটো আর স্বপ্ন দেখে না। কিন্তু আগে দেখত বলে মনে হয়। কর্মক্ষেত্রে তাঁর সুনামের ছড়াছড়ি। সততা, নিষ্ঠা ছিল তাঁর সম্বল, ব্যবহারে অমায়িক। কোনোদিন কারোর রাগ শোনেননি, এমনকী বড়োবাবুর পর্যন্ত। দিনরাত ভাবতেন গ্রাহককে কীভাবে সন্তুষ্ট রাখা যায়। আরও সুন্দর পরিষেবা দিতে কী কী করণীয় তাঁর। ভদ্রলোকের মতোই স্বপ্ন দেখতেন, হাইফাই কিছু নয়। একটা বাড়ি, তার চারপাশে বাগান, স্ত্রীর অপত্য ভালোবাসা, একটু বেরিয়ে আসা আর মানুষের মানবিক ভালোবাসা। এখন পেনশনের কয়েকটা টাকার আশা করেন, কোনোরকমে বেঁচে থাকার এতটুকু আশা, কম টাকায় চালিয়ে নেওয়ার ছোট্ট একটা বাজেট।
এখন পেনশনভোগীদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মানুষটি। সরু সরু পা জানিয়ে দেয় — ‘অনেকক্ষণ হল, আর পারছি না, এবার মুক্তি দিন!’ বসার জায়গা নেই। ব্যাঙ্কের লম্বা লম্বা চেয়ারগুলো কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, রেকারিং অ্যাকাউন্টওয়ালাদের দখলে। তাদের অনেক টাটকা স্বপ্ন, জীবনকে উপভোগ করার রঙিন আমেজ তাতে, তহবিলকে আরও পাকাপোক্ত করার স্বপ্ন।সঞ্চয়ের খাতা উপচে পড়ে, চলে যায় পরের পৃষ্ঠায়। এদিকে প্রায় চার ঘণ্টা লাইন দেওয়ার পর শোনা গেল — ‘ইয়ার এন্ডিংয়ের জন্য পেনশন এখনও ঢোকেনি’। পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সেক্শনে সারা বছরের করা আর না-করা কাজের বোঝা, সেইজন্যই দেরি। তবে দিনের আলো এখনও রয়েছে, ঢুকলেও ঢুকতে পারে, লাইন ছেড়ে বেরোয় না কেউ। হা-হুতাশ, কষ্টের গোঙানি পৌঁছায় না বসে থাকা ভদ্রলোকেদের কানে। দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে চলতে শুরু করেছে। দানাপানি নেই পেটে, সময় সমাপ্ত, ব্যাঙ্ক বন্ধ। না, সেদিন পেনশন ঢুকল না। হতাশ পেনশনভোগীরা, হতাশ সেই লোকটি। মনে একরাশ হতাশার অন্ধকার নিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই মিলিয়ে গেলেন। আবার পরদিন, না আজকে আর ফিরতে হবে না খালি হাতে, পেনশন এসে গেছে অ্যাকাউন্টে। টাকা পাবেন — মরা চোখে কেমন একটা ঔৎসুক্যের ঝিলিক। কাত্র ক-টি টাকা — তাতে মুদিখানা, আনাজওয়ালা, ইলেকট্রিকের বিল, নিজের ওষুধপত্র, স্ত্রীর ডাক্তারখানা …
লাইনে আর মাত্র দুজনের পরে, তারপরেই … তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ, জল খাওয়া দূরে থাক, টাকা পেলে একমাসের জমে থাকা তেষ্টার নিবারণ হবে। লাইন এসে গেল — চেক বাড়ালেন — চেক ফেরত এল। কাঁচের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে, ‘আপনার সই মিলছে না, কিছু করার নেই।’ বলেই ডাকলেন পরেরজনকে। লোকটি অনুনয়-বিনয় করে বললেন, ‘ইদানীং হাতটা বড়ো কাঁপে বাবা। এই বয়সে কি আর ঠিকঠাক হয়? দিয়ে দাও না বাবা। আমি তো প্রতিমাসেই আসি।’
চড়া মেজাজে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে ভেতর থেকে বলা হল, ‘বলছি হবে না, আপনি সরে যান। কোথা থেকে আসে সব! যান যান ম্যানেজারবাবুর কাছে।’
লোকটি নিরুপায় হয়ে ম্যানেজারবাবুর কামরার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু তিনি নেই। একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন মেন অফিসে। অসহায় লোকটি ফিরে এসে আবার অনুরোধ করলেন, ‘তুমি আমার ছেলের মতো বাবা, এই বুড়োটাকে আর কষ্ট দিও না।’ তাতেও ব্যাঙ্কবাবু রাজি হলেন না, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘যান বেরিয়ে যান বলছি। বিরক্ত করবেন না। আমায় কাজ করতে দিন।’
লোকটি ধৈর্য হারিয়ে রাগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন, কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমাকেও একদিন লাইনে এইভাবে হাত পেতে দাঁড়াতে হবে মনে রেখো। খালি হাতে ফিরতে হলেই বুঝবে বুড়োর কষ্টটা। আমি তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি, রেহাই যেন না পাও।’
কারেন্ট, সেভিংসওয়ালারা ছুটে এসে প্রবীণ লোকটিকেই ধমকালেন। কেউ কেউ রাগত স্বরে বললেন, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন, ওরা নিয়মের অধীন। ওদের তা মানতেই হবে। নাহলে ওদের চাকরি নিয়ে …
লোকটির দু-চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে থাকল। সে জলধারা কিন্তু নিয়ম মানে না।
Leave a Reply