অনুপম পাল, ৫ নভেম্বর, ফুলিয়া কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কথা শুনে লিখলেন জিতেন নন্দী#
ফুলিয়ার কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২০০১ সাল থেকে দেশি ধান নিয়ে কাজ শুরু হয়। দেবল দেবের বাঁকুড়ার খামার ‘ব্রীহি’ থেকে পাঁচখানা ধান নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০২ সালে। তারপর ২২ খানা ধান … এইভাবে করতে করতে ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগ আমাদের খামারকে জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ খামার হিসেবে ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে বছর বছর ধানের সংখ্যা ৪৫, ৭৫, ৯০, ১৩২ এইরকম বাড়তে বাড়তে এখন দেশি ধানের সংখ্যা ৩২৫টা। আমরা এই খামারে সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে চাষ করছি। যখন এখানে আমরা কাজটা শুরু করি, আমরা গোবর সার দিয়েছি, রক ফসফেট দিয়েছি, ধান-মিলের কালো ছাই দিয়েছি, খোল দিয়েছি, জীবাণু সার দিয়েছি। আস্তে আস্তে এগুলো থেকে সরে এসে গত তিন বছর ধরে গোবর সার দেওয়াটা বন্ধ করে দিলাম। শুধুমাত্র জলজ ফার্ন দিয়ে কাজ শুরু করলাম। এটাকে অ্যাজোলা বলে। এটা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো গ্রামাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যাবে। এই ফার্নের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। মোটামুটি ভাবে এক বিঘে জমিতে অ্যাজোলা প্রায় ৮ কিলোগ্রাম নাইট্রোজেন যুক্ত করতে পারে। অন্য একটা তুলনামূলক হিসেবে যদি বলি, তাহলে দেখব যে সতেরো কেজি ইউরিয়াতে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন পাওয়া যায়, তা এই অ্যাজোলা যুক্ত করছে। এটা করতে কিছুই লাগে না। চাষি যদি তার এক বিঘে ধানের খেতে ধান চাষ করার পরে এক ইঞ্চি জল রেখে এক-দু কেজি অ্যাজোলা এনে ছেড়ে দেয়, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো জমিটা কার্পেটের মতো সবুজ অ্যাজোলায় ভরে যাবে। এটা থাকলে জমিতে আগাছার পরিমাণ কম হবে, জমিতে জলীয় পদার্থের পরিমাণটা যোগ হবে। এটা মরে যাচ্ছে, আবার সংখ্যায় বাড়ছে। আমরা এটা কেন করলাম? আমরা মাটি পরীক্ষা করে দেখলাম, মাটিতে যে উদ্ভিদ-খাদ্য-জোগানদায়ী যে ছত্রাকগুলো রয়েছে, তাদের সংখ্যা এখানে অনেক বেড়ে গেছে। আমরা যেহেতু কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ব্যবহার করি না, শুধুমাত্র জৈব সার ব্যবহার করার জন্য এটা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, মাটিতে জৈব কার্বন — অন্যান্য চাষিদের জমিতে যেখানে রাসায়নিক সার ব্যবহার চলছে — সেখানে ০.৪% মতো আছে। আমাদের জমিতে তা ০.৮%-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। জৈব কার্বন বেশি রয়েছে এবং উদ্ভিদ-খাদ্য-জোগানদায়ী জীবাণু এবং ছত্রাকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তারা খাদ্য জোগান দিচ্ছে বলে আজ আমরা চোখের সামনে এত সুন্দর গাছ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং এটা বড়ো কথা যে চাষির উৎপাদন-ব্যয় কিন্তু আমরা বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারলাম। যেটা সবাই চেঁচামেচি করে, উৎপাদন-ব্যয় বাড়ছে বলে, সেই ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, এটা তার একটা দৃষ্টান্ত। একটাই শর্ত আছে যে এই জমিতে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যাবে না। যদি করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা সুস্থায়ী থাকবে না।
ধানটা উঠে যাওয়ার মুহূর্তে আমরা খেসারির ডাল মাঠে ছড়িয়ে দিই। এখানে খেসারি হয়, তা থেকে জমিতে নাইট্রোজেন যুক্ত হয়। চাষিকে জমিতে একবার একটা ডালশস্যের চাষ কিন্তু করতে হবে। আর ফসলচক্রের মধ্যে বিভিন্ন রকম ফসল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করতে হবে। আমরা কোনো বছর মুগ করি, কোনো বছর ধন্চে করি।
আমাদের অসুবিধে কতকগুলো আছে। একটা খোলা মাঠ, এখানে এত হনুমানের উপদ্রব যে ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারি না। হনুমান এসে জমিতে মুগ খেসারি খেয়ে যায়। কিন্তু ওই ফসলের নাইট্রোজেনটা আমরা পেয়ে যাচ্ছি। এখানে বেজি, সাপ, পোকামাকড়, ইঁদুর আছে। ধানে মৌমাছি আসে। প্রচুর পাখি আসে, ধান খেয়ে যায়। কিন্তু মুশকিলটা হল, আমাদের তো অল্প পরিমাণ ধান, খেয়ে গেলে ক্ষতি হয়। তাই এদের কিছুটা আটকাতে হয়।
ক্ষেত্রবিশেষ ও জাত অনুযায়ী এক কালি করে চারা লাগিয়ে বিঘেতে ১৭ থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যাবে। ইংরেজ আমলে বিঘায় ৩৫ মণ ফলনের রেকর্ড পাওয়া গেছে। বাংলায় বিঘায় ১৮-২০ মণ ধান ছিল। এখনও আছে।
বিভিন্ন জায়গার চাষিরা এসে এখানে ধান দেখে নির্বাচন করে যায়। করিমপুর থেকে চাষিরা ক-দিন আগে এসেছিল। এইবছর আমরা প্রায় ৬০ রকমের ধান চাষিদের দিয়েছি। চাষিরা জানে, খোঁজখবর রাখে। সরকারি রেটে আমরা তাদের কাছে ধানটা বিক্রি করি। এক বিঘের চাষে তো মাত্র এক কেজি ধান লাগে। খরচটা তেমন কিছু নয়। সারা জীবনের জন্য সেই প্রজাতির ধান তাদের হয়ে গেল। অ-আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাদের ২৬টা বীজ-কেন্দ্র আছে সাগর থেকে কোচবিহার পর্যন্ত। আমাদের কাছ থেকে নিয়ে তারা আবার স্থানীয় চাষিদের ধানটা দিচ্ছে। চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়লে তো দেশি ধানের চাষের কাজটা হবে না।
Leave a Reply