পার্থ কয়াল, ফলতা, ৩১ জানুয়ারি#
ট্রেন চলেছে বজবজ। মাঝেরহাট পেরোল। সকাল আটটা বাজব বাজব করছে। শীতের সকাল ঠান্ডায় জড়োসড়ো। রেললাইনের বাঁপাশে মাঝেরহাট স্টেশন পেরোলেই লেবেল ক্রসিং। পাশে বিল্ডিং উঠছে। জানলার পাশে বসে একজন সাতসকালে সিইএসসিতে (ইলেকট্রিক কোম্পানি) কাজে জয়েন করতে চলেছেন। মাফলারে মুখ ঢাকা। প্রশ্ন করলেন, কীসের বিল্ডিং? উত্তর এল, ওই কিছু একটার হবে। আর এত বিল্ডিং করে হবেটা কী? তারপর স্বগতোক্তি, আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কিছুই হবে না। যা হবে, ওই মালিকের আর যারা লেবার খাটবে তাদের। আরে হাজার ইটের দাম কম করে পাঁচ হাজার টাকা। এক বস্তা সিমেন্টের দাম ৩৭০ টাকা। না দাম একটু কমেছে, ৩৪০।
সাইডে তাস খেলা হচ্ছে — আরে তোর হাতে টেক্কা ছিল, তবুও তুই এটা মারলি। পাল্টা অন্যজন উত্তর দেয়, চেঁচামেচি শুরু হয়। পাশ থেকে একজন বলল, তোদের ওদিকে তো কাল বাওয়ালি হয়েছে। তাস খেলতে খেলতেই উত্তর, তাহলে আজ কোথায় খুলব? আরে দাদা, আজ গঙ্গার ধারে খাতা খুলে বসো। পুলিশ ধরতে এলে নদী পেরিয়ে নলপুর (বাটানগর) চলে যাবে। পাশ থেকে উত্তর আসে, আজও বাওয়ালি হবে। তা মাইনে না দিলে জিনিস তো চুরি যাবেই। আরে সেদিন শুনলাম, একজন গার্ডের কাজ করে, বলছে, আর বারো পিস রড নিলে ছাদ ঢালাই হয়ে যাবে। দেখো, গার্ডের কাজ করে রড নিচ্ছে। আরে কী করবে, আমাদের আগে পনেরো তারিখে মাইনে হত। এখন আঠাশ উনত্রিশ তারিখ চলছে। (এরা সব বিল্ডিংয়ের কাজ করে, আলুয়ালিয়া কনস্ট্রাকশন, বাটানগর)। পাশ থেকে একজন জিজ্ঞেস করে, ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না? আমাকে তো কাল ইলেক্ট্রিকের পয়েন্টের ড্রয়িং করালো। বিক্রি তো হয়েছে, তাই কাস্টমার দিয়েছে নিশ্চয়। আরেকজন বলে ওঠে, এদিকে ট্রেন ভাড়া বাড়লো, ছ-টাকারটা কমে পাঁচ টাকা আর সাতটাকারটা দশ টাকা। মান্থলি একশো টাকারটা পঁচাশি টাকা আর একশো পনেরো টাকারটা একশো ষাট টাকা।
যিনি সিইএসসিতে কাজ করেন, বললেন, আমাদের পেমেন্ট এখন ভালো হয়েছে। বেসিক, অ্যালাউয়েন্স নিয়ে চারশো টাকার সামান্য বেশি (রোজ)। ওটি-তে (ওভারটাইম) ডবল পেমেন্ট। সুযোগ সুবিধা ভালোই। এই আজ যেমন প্রচণ্ড ঠান্ডায় একটা বাড়ির কাজ সেরে বেরোতে দেরি হল, তা আটটায় জয়েন, ম্যানেজারকে ফোন করে বললাম, একটু দেরি হবে। বললেন, আসুন। দরকার থাকলে কাজ সেরে দুটোয় বেরিয়ে আসা যায়। তার মানে সমস্ত সুযোগ সুবিধাই আছে, আলুয়ালিয়ার একজন শ্রমিক বললেন। সিইএসসির শ্রমিক জবাব দেন, আরে সিইএসসি আগে ছাই ফেলার জমির জন্য দাম দিত লোককে। এখন লোকে ছাই কেনে পয়সা দিয়ে। ছাই থেকে তৈরি ইট বেশ শক্ত, ১৩০ টাকা টন। ছাই মাটিতে ফেলে ভরাট করলে শক্ত ইটের মতো জমে যাচ্ছে। আবার ছাইয়ের ট্যাঙ্কে ওপরের দিকে যে সর পড়ে সেগুলো প্রচুর দামে বিক্রি হয়। এদিক থেকে একজন জানতে চাইলেন, ইট কোথায় তৈরি হয়? উত্তর এল, পূজালিতে পৌরসভার পিকনিক স্পটের পাশে। চারকোণা পিলার তুলে ওই ইটে গাঁথলে পোক্তও হবে, খরচও কম হবে। পাশ থেকে অন্য একজন বললেন, ওদিকে গেলে ইটের খোঁজ পাওয়া যাবে না? (২৯ জানুয়ারির কথোপকথন)
আলুয়ালিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে একজন বাঘাযতীন থেকে নুঙ্গি টিকিট কেটেছেন, দশ টাকা। আর মান্থলি করানোর খোঁজ নিচ্ছেন। আকড়ার ভাড়া পাঁচ টাকা। অন্য একজন বললেন, আকড়ারই মান্থলি করাব। তাস খেলছিলেন একজন, পাশ থেকে বললেন, এ মাসে আমার তেরোদিন কামাই। সাড়ে তিন হাজার টাকা লস। যিনি মান্থলি করাতে চান, তিনি কলকাতায় নতুন এসেছেন। মান্থলি কোথায় করাবেন জিজ্ঞেস করলেন। একজন হেসে বললেন, মান্থলি কি কোম্পানির গেটে করাবে? পাশ থেকে টিপ্পনি, আরে অমুকদা, বৃন্দার দোকানে (চোলাই মদের ঠেক) ওর মান্থলিটা করিয়ে দাও। (৩০ জানুয়ারির কথোপকথন)
Leave a Reply