তারকেশ্বরের ভাঞ্জিপুর নিবাসী সুশান্ত দত্ত-র সাথে ফোনালাপের ভিত্তিতে রিপোর্ট, ১৩ মার্চ#
তারকেশ্বর সহ হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খেতগুলোতে সব আলু পড়ে আছে। কেউ কিনছে না।
আলু ব্যবসা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। কিন্তু আলুচাষির কাছে আলু চাষের খরচ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বীজের দাম বেড়েছে। সারের দাম বেড়েছে চড়া হারে। ওষুধের দাম বেড়েছে খুব দ্রুত। তিন বছর আগে আলুর ধ্বসা রোগ প্রতিরোধ ও ফলন বাড়ানোর জন্য একটি বহুজাতিক কোম্পানির ওষুধের দাম ছিল ১৫০টাকা, এখন হয়েছে ৪৫০/৫০০ টাকার মতো। কিন্তু উল্টোদিকে, চাষিদের কোনো একতা নেই। তারা কিছুতেই আলু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
হুগলির তারকেশ্বরে আজকে একমাস হতে চলল আলু গাছ মরতে শুরু করেছে, অর্থাৎ আলু তোলার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু তারকেশ্বরে আলু কেনার কোনো খদ্দের নেই। আগে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা খেত-এ এসে চাষির সঙ্গে কথা বলতে, পঞ্চাশ ষাট বস্তা করে কিনত। সেগুলো চালান হতো কলকাতা/হাওড়ায় পোস্তা বা জানবাজারে। কিন্তু এবারে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কেউ আলু কিনছে না। অথচ, এলাকার হিমঘর গুলোর আশেপাশে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় বড়ো বড়ো আলুভর্তি ট্রাক, ট্রাক্টর। দাঁড়িয়ে আছে, হিমঘরে আলু জমা করার অপেক্ষায়। হিমঘর খুলেছে কুড়ি দিন মতো হলো।
এখন অবশ্য যোগাযোগের সুবিধার জন্য আলুর বাজার কেবল পোস্তা বা জানবাজার নয়। সারা দেশ, এমনকি বিদেশ (বাংলাদেশ-ও)। ব্যবসার ক্ষেত্র অনেক বেড়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলোকে জিজ্ঞেস করে জানা যাচ্ছে, এই আলু নাকি হিমঘরে আসছে বাঁকুড়ার সোনামুখী, শ্যামসুন্দর প্রভৃতি জায়গা থেকে। ওইসব জায়গায় ভালো আলু হয়েছে। কিন্তু চাষিরা খুব কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ওখানে কাছাকাছি এত হিমঘর নেই। সেখান থেকে আলু কিনে নিয়ে এসে হুগলির হিমঘরগুলোতে আলু রাখা হচ্ছে। এর কতটা সত্যতা আছে কে জানে। তবে এটা ঘটনা, তারকেশ্বরের এলাকার জমির আলু কেনার মতো খদ্দের নেই, আবার এলাকার হিমঘরগুলোর সামনেও লম্বা লাইন। তবে, আলু ব্যবসায়ীরা যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত শাসক দলকে প্রচুর চাঁদা দেয়, তাই প্রশাসন-সরকারেরও নিয়ন্ত্রণ থাকে না এই ব্যবসায়ীদের ওপর। তার ওপর এবারে আবার নির্বাচনের দামামা বাজছে বিভিন্ন জায়গায়।
আগে রেল-এ করে তারকেশ্বরের আলু নিয়ে যাওয়ার জন্য রেললাইনে ৫০-৬০টা করে রেক আসত। এবারে আমি একটাও দেখিনি। রেল-এ আলু যেত ভারতের অন্যান্য প্রদেশে। এবারে কি সেখানেও এখনও আলুর চাহিদা নেই? এবারে আমাদের তারকেশ্বরেও আলুর চাষ বেশি হয়েছে। শুনছি গোটা রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি চাষ হয়েছে। এটা যদি অন্যান্য রাজ্যে না যায়, তাহলে খুব মুশকিল।
আলু চাষ করা হয় কো-অপারেটিভ বা মহাজনদের কাছে ধারকর্য করে। অনেক সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও ধার করা হয়। চাষি নিজে যদি স্টোর-এ রাখে, সেক্ষেত্রে পঞ্চাশ কেজি বস্তার এক বস্তা আলুর খরচ স্টোরে রাখার খরচ ধরে নিয়ে পড়ে যায় চারশো টাকার মতো। সেটা বিক্রির সময় যদি লাভ রাখতে হয়, তাহলে তো পাঁচশো টাকা মতো দাম করতে হবে, অর্থাৎ কেজি প্রতি দশ টাকা। সেই আলুই খুচরো বিক্রেতার মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে হয়তো পনেরো টাকা কেজি দাম হয়ে যাবে। তখন সাধারণ উপভোক্তা জিজ্ঞেস করবে, এত দাম কেন আলুর?
দামোদরের অববাহিকায় পোখরাজ প্রভৃতি যে আলুগুলো ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে উঠে যায়, সেগুলোর ভালো চাষ হয়। এবারেও হয়েছে। ওইসময়ে ওখানকার আলুচাষিরা বস্তা পিছু ২৫০-২৬০টাকা করে দাম পাচ্ছিল। শুনছি, ওখানকার চাষিরা তখন ওগুলো বিক্রি করতে চায়নি, পরে আরো ভালো দাম পাওয়া যাবে এই আশায়। কিন্তু এখন সেই পোখরাজ আলুর দামও গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে, একশ’ টাকা বস্তা। ফলে সেখানকার চাষিদের মাথায় হাত।
চাষিদের অবস্থা আরো সঙ্গীন হচ্ছে অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ার জন্য। বৃষ্টি হয়ে গেলে চাষিরা আলুর জমিতে তিলটা বুনে দিতে পারত, তারপর আরেকটা বৃষ্টি হলেই তিলটা হয়ে যেত। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় তাও করা যাচ্ছে না। অবশ্য, তিলের এখন বাজার খুব নেই। আমি অনেক বাড়িতে দেখছি, গতবারের তিল পড়ে আছে। হয়ত পাটের মতো তিল চাষও বাজারের অভাবে উঠে যাবে আস্তে আস্তে।
বৃষ্টি না হওয়ায় আলু চাষেরও খরচ বেড়েছে। বৃষ্টির অভাবে এবং আরো নানা কারণে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। শ্যালোতে জল আসছে না। সেক্ষেত্রে ৬-৭ ফুট গর্ত করে শ্যালো বসিয়ে তবে জল তুলতে হয়েছে। কেরোসিন দিয়ে সেই জল তোলার খরচ অনেক। অনেক চাষিই দূরের শ্যালো থেকে পাইপে টেনে জল এনে আলুতে দিয়েছে। আমি তো একজনকে দেখেছি তেইশ-শো ফিটের পাইপ দিয়ে জল টানতে। তাতেও খরচ বেড়েছে।
Leave a Reply