তমাল ভৌমিক, কলকাতা, ৩০ মার্চ#
দিনেদুপুরে খুন হলেন সতীশ শেট্টি |
‘আমরা জানতাম, যেসব মানুষের সঙ্গে অপরাধীদের যোগাযোগ আছে এবং যারা অর্থবলে বলীয়ান তাদের কাছে ওর কাজকর্ম ছিল দু-চোখের বিষ, কিন্তু তাদের স্পর্ধা যে কতখানি তা আমরা বুঝিনি’ — একথা বলেছেন সন্দীপ শেট্টি, তাঁর ভাই সতীশ শেট্টির মৃত্যুতে।
সতীশ শেট্টি ছিলেন তথ্যের অধিকার আন্দোলনের এক কর্মী। তিনি মহারাষ্ট্রের অনেক জমি-কেলেঙ্কারীর কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। একদিন সকালে তিনি যখন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটছিলেন তখন কিছু অপরিচিত দুষ্কৃতী তাঁকে খুন করে। ১৪ জানুয়ারি ২০০২ বোম্বে হাইকোর্ট মহারাষ্ট্র সরকার ও রাজ্য-পুলিশকে সতীশের খুনের তদন্তের নির্দেশ দেয়। সন্দীপ শেট্টি বলেন, ‘সরকার ঘোষণা করেছিল যে জমি-হাঙ্গর ও জমি-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতিতে কোনো কাজ হয়নি। যে লোকটা দশহাজারের বেশি মিথ্যা মামলার কথা প্রথম বলে দিয়েছিল এবং বহু জমি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিল তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হল।’
শেট্টির ঘটনা প্রথম নয়। মহারাষ্ট্রে এরকম আরও অনেক তথ্যের অধিকার আন্দোলনের কর্মীকে খুন করা হয়েছে, যারা কোনো না কোনো কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছে। এই ধরনের কর্মীদের ভয় দেখানো ও এদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক সংগঠন আছে। তার নাম সংক্ষেপে ‘মিত্রা’ (MITRA মুভমেন্ট এগেনস্ট ইন্টিমিডেশন, থ্রেটস অ্যান্ড রিভেঞ্জ এগেনস্ট অ্যাকটিভিস্টস)। এই সংগঠনের আহ্বায়ক মিস আব্দুলালি এই ধরনের কর্মীদের খুনের হিসাব দিতে গিয়ে বলছেন,’প্রেমকান্ত ঝা, সতীশ শেট্টি, অরুণ সাওয়ান্ত, ভিথাল গিতে, দত্তাত্রেয়া পাতিল, ইরফান ইউসুফ কাজী এবং আরও অনেক…নামের তালিকার শেষ নেই’।
গত কয়েক বছরের মধ্যে যেসব কর্মীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে তাদের তালিকা বানিয়ে ‘মিত্রা’ সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আর আর পাতিলকে চিঠি দিয়ে সব জানানো হয়েছে। মিস আব্দুলালি আরও বলেছেন, ‘তথ্যের অধিকার আন্দোলন কর্মী বলেন, ‘বহু ঘটনাতেই আমরা দেখেছি যে আক্রান্ত কর্মী যেসব খবর প্রকাশ করে দিয়েছে তাতে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও মাফিয়াদের এমন সব অংশের মুখোশ খুলে গিয়েছে, যারা সরাসরিভাবে বা ঘুরপথে এমন ক্ষমতাপ্রয়োগ করে যাতে কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কোনো অবস্থানই গ্রহণ করা যায় না’। জেমস জনের ওপর পাঁচবার আক্রমণ চালানো হয়েছে। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘২০০৮ সালে আমি একটা দাঙ্গার ঘটনা ভিডিয়োতে তুলেছিলাম। দাঙ্গাবাজরা আমাকে এমন পেটায় যে আমার পাঁজরের তিনটে হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল, আমাকে কিছুদিন, হাসপাতালের আই সি ইউতে এবং কয়েকমাস বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছিল – তবে আমি প্রাণে বেঁচে গেছি’।
আটাত্তর বছর বয়স্ক এইচ সি ডেলিমা বলেন, ‘ যে কাজ আমি করি, তাতে আমাকে কেউ খুন করে দিলে অবাক হব না। বেশ কিছু লোক অনেক টাকা বানাতে পারে, যদি আমাদের মতো লোকেরা কোনো প্রশ্ন না তোলে’। আন্ধেরীতে জমি মাফিয়াদের উৎখাত করার কাজ করার জন্য ২০০৫ সালে ডেলিমাকে তাঁর বাড়ির সামনে কাস্তে হাতে নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল।
কেলেঙ্কারি ফাঁস করার শুরুর কাজ যারা করে তাদের ‘বাঁশিবাদক’ বা ‘হুইসল ব্লোয়ার’ বলা হয়। এদের এক সর্বভারতীয় সংগঠনের সম্পাদক রাজেশ দারাখ, ডেলিমার ওপর আক্রমণের ঘটনার তদন্ত করে জানান, ‘থানায় এফআইআর নথিভুক্ত করাতে গেলেও আপনার চেনা পুলিশ অফিসার থাকতে হবে। সব পুলিশই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া এবং পুলিশের কাজে নিষ্ঠা না থাকার জন্যই এই ধরনের হামলা বাড়ছে’। তিনি আরও বলেন, বিচারব্যবস্থার শ্লথতা ও ত্রুটির সুযোগও অপরাধীরা নেয়।
সরকারি কাজে স্বচ্ছতা আনার জন্য তথ্যের অধিকার জানার আইনকে কাজে লাগিয়ে কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে নায়ক যদি কাউকে বলতে হয় তাহলে এরাই সেই বীর নায়ক। কিন্তু মাফিয়া, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের একটা অংশের দুষ্টচক্র এদেরকে বাঁচতে দিচ্ছে না।
মিস আব্দুলালির মতে, ‘এই ধরনের কর্মীদের কাজের কোনো সুনাম হয় না। জমি-মাফিয়া ও খনি-মাফিয়া যেসব অপরাধীরা আছে তাদেরকে শত শত মানুষ চেনে। কিন্তু তাদের কুকীর্তি ফাঁস করে দেয় যে কর্মীরা, তাদের ওপর যখন ওরা আক্রমণ চালায় তখন কেউ সাহায্য করে না। পুলিশ সাময়িকভাবে এই কর্মীদের সুরক্ষা দেয় এবং তার ফলে ব্যাপারটা আরও বেশি জানাজানি হয়ে যায় এবং তা আরও উৎপাত ডেকে আনে। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরও নিরাপদ পরিবেশ চাই’।
সূত্র, ‘দি হিন্দু’ পত্রিকা, ১৪ মার্চ ২০১১।
Leave a Reply