সুব্রত দাস, বদরতলা, মেটিয়াবুরুজ, ১৩ জুলাই#
কলকাতা কর্পোরেশনের ১৫নং বরো-র ১৪১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমরা। সম্প্রতি আমাদের বরোর বাড়ির ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে আমার কাছে চিঠি এসেছিল, তাতে উল্লেখ ছিল যে আমাদের বাড়ির নতুন করে ট্যাক্স নির্ধারিত হবে। আমি নিজের তাগিদে ওই ডিপার্টমেন্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে দেখা করে এর কারণ জিজ্ঞাসা করি? তিনি বলেন, ‘দুঃখিত, কলকাতা কর্পোরেশন মেগাসিটি প্রকল্পের অন্তর্গত। অতিরিক্ত ট্যাক্স আপনাকে দিতেই হবে।’ আমি এক এক করে ওঁর কাছে কলকাতার প্রান্তিক ওয়ার্ড ১৪১ নম্বরের চালচিত্র তুলে ধরি।
১। আমাদের বদরতলা থেকে দেড়-দুই কিমি পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর পাই পাবলিক বাস। কোনো সরকারি বাস নেই, বদরতলা (রাজাবাগান বাসস্ট্যান্ড) থেকে ছাড়ে তিনটে বাস। শিয়ালদহগামী ১২নং বাসে বসলে শিয়ালদহ পৌঁছাতে সময় লাগে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। ওই সময়ে ধর্মতলা থেকে বাসে ১৮৫ কিমি দূরে দীঘা পৌঁছে যাওয়া যায়! বদরতলা থেকে ছেড়ে রামনগর হয়ে সোজা তারাতলা, তারপর আবার টাঁকশালের আগে বাঁক নিয়ে পিছনে হাইড রোড, আরও পিছনে এসে সিগারেট কলের ক্রসিং থেকে পুরো বিএনআর ঘুরে নজরুল সেতুর মুখে বেরিয়ে শিয়ালদহ যাত্রা, সময় তো লাগবেই! অন্যভাবে ট্রেন বা ট্যাক্সি ধরলে শিয়ালদহ পৌঁছাতে চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আর একটা বাস ১২এ, বদরতলা স্ট্যান্ড থেকে হাওড়া যেতে লেগে যায় আড়াই ঘণ্টা। এটাও দুনিয়া ঘুরতে ঘুরতে হাওড়া পৌঁছায়! আদতে এটাও গাড়িতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ। বদরতলার লোকে শিয়ালদহ বা হাওড়া যেতে এই বাস দুটোতে সাধারণত ওঠে না। একমাত্র বদরতলা থেকে ধর্মতলাগামী ১২ শাট্ল বাসটাতে সাধারণ যাত্রীরা ওঠে। এই বাস ধররমতলা পৌঁছে দেয় পঞ্চাশ মিনিটে। তবে বর্তমানে কোনো বাসই সময় মতো চলতে পারছে না। কারণ গার্ডেনরীচ শিপবিল্ডার্সের রাজাবাগান ৪৪নং গেটের সামনে তানসিয়া গ্রুপের ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ লাইনের কাজ চলার দরুন দীর্ঘকাল ধরে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতি চলছে। দু-চাকা যান কিংবা রিক্সা চলাও দুষ্কর। অনেক পথ ঘুরে ঘুরে নিত্যদিন সাধারণ মানুষ, প্রাইভেট গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, এমনকী অটো যাতায়াত করছে। রামনগর থেকে আমাদের বদরতলা মোল্লাপাড়া পর্যন্ত একটা অটো চলে। সন্ধের পর সেই অটো আর আমাদের বদরতলায় ঢোকে না, বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী নামিয়ে দেয়। তখন দীর্ঘ পথ রিক্সা নয় পায়ে হেঁটে বদরতলায় যেতে হয়।
২। বদরতলায় কোনো নার্সিং হোম নেই। সরকার পরিচালিত হাসপাতাল আছে। তবে সেখানে ডায়েরিয়া ছাড়া অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা হয় বলে আমার জানা নেই। কোনো এক্স-রের ব্যবস্থাটুকুও নেই। সামান্য সমস্যা নিয়ে গেলে বলে পিজি-মেডিকালে চলে যান। রাতবিরেতে বিপদ ঘটলে কোয়াক বা হাতুড়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হতে হয়।
৩। পুরো ১৪১নং ওয়ার্ডে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনেজ লাইন নেই। সারা কলকাতা জুড়ে নতুন করে মাটির তলায় ড্রেনেজ লাইন করা হল। ১৪১নং ওয়ার্ড বাদ পড়ল। বর্ষার সময় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
৪। এতদঞ্চলে টাইম কল দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। যেগুলো আছে, এক বালতি জল ভরতে সময় লাগে কমপক্ষে দশ মিনিট। ইদানীং সকালের দিকে একটা কর্পোরেশনের জলের গাড়ি আসে মাঝে মাঝে।
৫। আমাদের নিকটবর্তী রেলস্টেশন সন্তোষপুর। ওই স্টেশনে যাওয়ার কোনো বাস বা অটো নেই। নিজস্ব সাইকেল আর নয়তো রিক্সা ভরসা। আর দুটো জলপথ রয়েছে রাজাবাগান ঘাট থেকে পোদড়া এবং বিচালিঘাট থেকে নাজিরগঞ্জ। এই দুটো ঘাট থেকে যদি হাওড়া বা আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লঞ্চে যাওয়া যেত, তাহলে সড়কপথের ঝামেলা এড়িয়ে মানুষের উপকার হত।
৬। এর ওপর রয়েছে গঙ্গার পারের ভাঙন। রিভারসাইড রোড, কাঞ্চনতলা প্রভৃতি এলাকায় গঙ্গার ভাঙন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার নিজের চোখের সামনে একটা বড়ো খেলার মাঠ পুরো নদীগর্ভে চলে গেছে।
এসব শোনার পরও কি আপনি বলবেন আমরা মেগাসিটি প্রকল্পের আওতায় এসেছি? অফিসার এসব কথার কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। আমি ট্যাক্সের অতিরিক্ত বোঝা মাথায় চাপিয়ে বরো-অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম, চুপিসাড়েই। কারণ এরপরও কিছু বলতে গেলে মাওবাদী আখ্যা পাই আর কি!
Leave a Reply