উজান চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপুর, ১৩ আগস্ট#
উত্তর দিনাজপুরের এক জমজমাট শহর কালিয়াগঞ্জ। সেখানে গত ২ আগস্ট আমরা গিয়েছিলাম অচলায়তন’ নাটকের অভিনয়ে। সেদিন অভিনয় বেশ হয় এবং এত দর্শক আসেন যা সচরাচর দেখা যায় না। অভিনয়ের পরের দিন সকাল থেকেই মনটা খুঁতখুঁত করছিল যে কখন কাছেপিঠে বেড়াতে যাব। তা প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা বেড়াতে বেরোলাম। আমরা যাব ‘টেরাকোটা গ্রাম’। নামটা প্রথম থেকেই অদ্ভূত লেগেছিল। একটা মজা হল এই যে জমজমাট কালিয়াগঞ্জ শহরটা থেকে ভেতরে ঢুকলেই একেবারে অজ পাড়া গাঁ। দুপাশে বিরাট ধানের খেত, মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল গাছ আর মধ্যে দিয়ে রাস্তা। সেদিন রোদও উঠেছিল। চারপাশ অদ্ভূত মায়াবী লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে পৌঁছনো গেল টেরাকোটা গ্রাম’-এ। রাস্তার বাঁ পাশে জলা, তার পাশ দিয়ে বাঁশ গাছের সারি উঠে গেছে। তার নিচে দাঁড়িয়ে সে যে কি শান্তি তা বলে বোঝাতে পারব না। মনে হল এতদূর আসার সব ক্লান্তি ধুয়ে গেল। তারপর গ্রামে ঢোকা হল।
প্রত্যেক ঘরেই মাটির অসামান্য, অসাধারণ হাতের কাজ। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল যে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য হল তা তৈরি হয় ছাঁচ দিয়ে। আর এই টেরাকোটা শিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য হল তা তৈরি হয় হাত দিয়ে কেটে। একদম ছোটো থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধা পর্যন্ত সবাই ওই মাটির কাজ করেন। অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস তারা মাটি দিয়ে গড়েছে। যেমন হ্যারিকেন — তার ভেতরে কী অদ্ভুত কুশলতার সঙ্গে চার ধার দিয়ে ফুটো করা। যাতে আলোটা ছড়িয়ে পড়ে নানা আকৃতিতে। সেটা আবার মাটিরই গোল গোল চাকতি দিয়ে দড়ি তৈরি করে ঝোলাবার ব্যবস্থা। আরেকটি দেখলাম প্রদীপ। একটা মাটির পাত্রের ওপর প্রদীপটা রাখা। তার ওপর আবার ঢাকনা। সেটাও কাটা কাটা। ঢাকনাটাকে খুলে প্রদীপ জ্বালানোর যে কাজ সেগুলো করে ফের ঢাকনাটাকে আটকে দেওয়া এবং যথারীতি কাটা কাটা পাত্রের মধ্যে দিয়ে আলো নানা আকৃতিতে ঠিকরে বেরোচ্ছে। এছাড়াও কাপ ডিশ, মুখোশ কত কী। এরপর গেলাম যেখানে এর মাটির মডেল তৈরি হয় সেখানে। চাক ঘুরছে। যিনি তৈরি করছেন তিনি শুধুমাত্র হাতের আলতো ছোঁয়ায় তৈরি করে ফেলেছেন ফুলদানী, কাপ, ডিশ, প্রদীপ, হ্যারিকেন। অসামান্য, অসাধারণ জাদু তার হাতের আলতো ছোঁয়ায়। সব ঘরবাড়িই মাটির তৈরি। এই অঞ্চলই হল আদি কালিয়াগঞ্জ। এই অঞ্চলের নাম কুনোর।
ক’দিন আগেও এই অঞ্চলের অধিবাসীরা অর্থাৎ সেই টেরাকোটা শিল্পীরা আমাদের কাছে অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু কালিয়াগঞ্জ অনন্য থিয়েটারের বিভুভূষণ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাদের তৈরি শিল্পসামগ্রী নিয়ে একটি মেলা হয়। তারপর থেকে তারা আমাদের চোখে পড়তে থাকে। তাদের আর্থিক অবস্থাও ভাল। আমার কাছে এটাই আশ্চর্যের যে পুরুষানুক্রমে তারা ওই একটি অঞ্চলে তাদের হাতে গড়া মাটির শিল্প বানিয়ে চলেছে এবং তারা ভাল আছে। বর্তমানে সেখানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আনন্দের খবর এই যে তাদের তৈরি শিল্প সামগ্রী বর্তমানে আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি শহরেও যাচ্ছে।
আমাদের কাছেই এত ভালো কয়েকজন যোগ্য, দক্ষ ও গুণী শিল্পী রয়েছেন। তাঁদের যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি বোধহয় আমাদের শিল্প সংস্কৃতির স্তরটাও কয়েকধাপ চড়ে যাবে।
Leave a Reply