সম্প্রতি দিনহাটা ও কোচবিহারে কয়েকটি সভায় উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে বন্যা ও ধস নিয়ে কিছু আলোচনা হয়। একটি আলোচনায় শ্রোতারা আলোচকের সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাগুলিকে বিনিময় করেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে বড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ডিনামাইট ব্লাস্টিং করে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আজ যখন বিপর্যয় এল, তখন প্রকৃতি যেন সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিল! নদী আবার তার স্বাভাবিক প্রবাহে ফিরে এল। মন্দাকিনী নদীর ক্ষেত্রে কেদারঘাটিতে এটাই ঘটেছে। এই বিবরণ শুনতে শুনতে একজন মহিলা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলে ওঠেন, ‘জয়ন্তী পাহাড়ে ডিনামাইট ব্লাস্টিং হলে কোচবিহার শহরটা কেঁপে ওঠে’।
জয়ন্তী পাহাড় কোচবিহার শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি দূরে। ভাবতেও শিউরে উঠি। ওই মন্তব্য শুনে আর একজন শ্রোতা স্বগতোক্তি করেন, ‘আসলে আমরা তেমন গা করি না। একটা বড়ো ট্রাক রাস্তার ওপর দিয়ে গেলেও তো চারপাশ কাঁপে। কখন কী জন্য কম্পন হয়, কে অত খবর রাখে!’ কিন্তু এই প্রত্যেকটা কাঁপন অগোচরে আমাদের ভিটে-মাটি, পথঘাট সবকিছুকেই নড়বড়ে করে দেয়। উত্তরাখণ্ডের মেখণ্ডা গ্রামের ঘরে ঘরে দেওয়ালে ফাটল ধরে। তবু মানুষ সাবধান হয় না। আরও বড়ো বিপর্যয়ের জন্য সে যেন অপেক্ষা করে বসে থাকে।
আলোচনায় মগ্ন হয়ে প্রত্যেকের মনে নানান প্রশ্ন জেগে ওঠে। তাদের সামনে ভেসে ওঠে উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীর ছবি। সেই নদীর বুকে বাঁধ আর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের তাণ্ডবের ছবি! একদিকে আসন্ন বিপন্নতার ছবি, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (বা এনার্জি) নির্ভর আধুনিক জীবনের হাতছানি। কোনটাকে সে উপেক্ষা করে? সভায় কলেজের ছাত্র যারা এসেছিল, তারা তো সেই আধুনিক জীবনের পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার জন্যই লড়াইয়ে তৈরি হচ্ছে! সে তো ছোটোবেলা থেকে শিখে এসেছে, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। ফলে পাহাড়, জলবিদ্যুৎ থেকে সরে আলোচনাটা চলে যায় বিদ্যুতের প্রয়োজন কতখানি সেই প্রশ্নে। এসে যায় মানুষের প্রয়োজন ও অপচয়ের প্রশ্ন; প্রয়োজন ও লোভের প্রশ্ন।
জয়ন্তী পাহাড়ে ডিনামাইট ব্লাস্টিং হলে কোচবিহার শহরটা কেঁপে ওঠে। সেই কম্পনের অনুরণন যেন সভার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। সকলেই যেন বুঝতে পারি, পায়ের নিচে শক্ত মাটিটা কত প্রয়োজনীয়।
Leave a Reply