সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৫ আগস্ট#
একটি বেসরকারি টিভি সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে দার্জিলিং-এর এক পাহাড়ি যুবকের চ্যাম্পিয়ন বা রানার্স হওয়া নিয়ে পাহাড়বাসীর গোর্খাল্যান্ড আবেগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল ২০০৭ সালে। আগের দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল ভেঙে ফের জেগে উঠেছিল গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন, রাতারাতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল নেতৃত্বদায়ী সংগঠন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এবার শেষ জুলাই-এ অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরির প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে আসার পর থেকেই গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ফের সরব হল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলা দার্জিলিং-এর পাহাড়বাসী। একইসাথে, ২০১১ সালের জুলাই মাসে গঠন হওয়া অন্তর্বতীকালীন বন্দোবস্ত ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিসট্রেশন’ (সংক্ষেপে জিটিএ) সম্পূর্ণ বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের পক্ষে একজোট হয়ে গেল পাহাড়ের মানুষ। জনমতের চাপে পড়ে জিটিএ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা জনমুক্তি মোর্চা ২৯ জুলাই ৭২ ঘন্টা পাহাড় বনধ্ ডাকে। বনধ্-এর দ্বিতীয় দিনে ৩০ জুলাই তড়িঘড়ি রাজ্যপালকে একটি চিঠি লিখে জিটিএ প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন মোর্চা নেতা বিমল গুরুং। সেই সঙ্গে দু-দিন পর থেকেই শুরু হয় মোর্চার ডাকে অনির্দিষ্টকালের পাহাড় বনধ্। এই বনধ্-এ পাহাড়বাসী নিরঙ্কুশ সাড়া দেয়।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পাহাড়ের অসন্তোষ সামাল দেওয়ার জন্য আলাদা করে ছয় কোম্পানি আধা সেনা মোতায়েন করে পাহাড়ে। একইসাথে পাহাড়ে আন্দোলনকারীদের ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ প্রশাসন। ১৪ আগস্ট দার্জিলিং জেলা পুলিশ সুপার কুণাল আগরওয়াল হিসেব দেন, ৩ আগস্ট অনির্দিষ্টকালের বনধ্ শুরুর পর থেকে ৩৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনির্দিষ্টকালীন বনধ্ তুলে নেওয়ার জন্য ৭২ ঘন্টা সময় দেয় মোর্চাকে। ১২ আগস্ট মোর্চার নেতৃত্বে পাহাড়ের আটটি সংগঠন একজোট হয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আটটা সংগঠন হল, মোর্চা, সিপিআরএম (এটি নয়ের দশকে সিপিএম থেকে বেরিয়ে এসেছিল), অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ, হিল কংগ্রেস এবং হিল বিজেপি (কংগ্রেস ও বিজেপির পাহাড় শাখা, যারা উঁচুতলার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে সামিল হয়েছে), গোর্খা রাষ্ট্রীয় কংগ্রেস, গোর্খা রাষ্ট্রীয় নির্মাণ মোর্চা, ভারতীয় গোর্খা পরিসঙ্গ। এরা ছাড়াও অংশ নেয় গোর্খাল্যান্ড টাস্ক ফোর্স নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন।
হাইকোর্ট বনধ্ বেআইনি ঘোষণা করার পর জনমুক্তি মোর্চা ণ্ণজনতা কার্ফু’-র ডাক দেয় এবং নিজেরা সমস্ত ধরণের পিকেটিং তুলে নেয়। জনতা কার্ফুতেও সমগ্র পাহাড়ের রাস্তা-ঘাট-হাট-বাজার জনশূণ্য থেকে আন্দোলনের স্বতস্ফুর্ততাকে দেখিয়ে দেয় চোখে আঙুল দিয়ে। এমনকি দুধ-জল প্রভৃতির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবাও বন্ধ ছিল। কলকাতা হাইকোর্ট জনতা কার্ফুকেও বেআইনি ঘোষণা করে। রাজ্য সরকারের তরফে পাহাড় জুড়ে এগারোটি জায়গায় থানা, প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি স্থান থেকে রেশন দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় ১৩ তারিখ। পাহাড়বাসী আন্দোলন ভাঙার এই সরকারি চক্রান্তকে প্রত্যাখ্যান করে। একইসাথে সরকারের তরফে বিক্ষোভ ঠেকাতে পাহাড়ে সমতল থেকে জল কামান আনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত কিছু সরকারি বাস চালানোরও বন্দোবস্ত করা হয়।
জনমুক্তি মোর্চা ১৫ থেকে ১৮ আগস্ট বনধ্ স্থগিত রাখার ডাক দেয়। কিন্তু লোকমুখে প্রচারিত হয়ে যায়, কেবল ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের জন্য বনধ্ বা জনতা কার্ফু স্থগিত রাখা হয়েছে। পরদিন থেকে ফের শুরু হবে। কালিম্পং থেকে দার্জিলিং — সব জায়গাতেই মানুষ টানা বনধ্ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় নিজে থেকেই। প্রকাশ্য পোস্টার দেওয়ালে দেখা যায়, টানা বনধ্ চালিয়ে যেতে চেয়ে। জনমুক্তি মোর্চার পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচী ১৬ আগস্টের সর্বদলীয় বৈঠকে ঠিক হবে। বৈঠকের আগে ১৫ আগস্ট গোর্খাল্যান্ড টাস্ক ফোর্স সহ কয়েকটি সংগঠন প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়, গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের জন্য টানা আক্রমণাত্মক কর্মসূচী থেকে সরে আসার কোনও প্রশ্নই নেই। এবং অবিলম্বে জিটিএ বাতিল করতে হবে।
গোর্খাল্যান্ডের দাবি ১০৭ বছরের পুরনো। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরে আসার কোনও লক্ষণই পাহাড়বাসী দেখায়নি কোনওদিন। একের পর এক নেতা ও নেতৃত্বদায়ী সংগঠন তৈরি করে গেছে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে। কখনও তার নাম সিপিআই, কখনও জিএনএলএফ, কখনও বা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। প্রত্যেকেই অনেক আশা জাগিয়ে শুরু করার পর ফের কোনও না কোনওভাবে সমঝোতা করে নিয়েছে দুধ-এর বদলে ঘোল নিয়ে।
samrat sarkar says
বেশ কয়েক বছর আগে দার্জিলিঙ জেলার মংপু বলে একটা জায়গায় গেছিলাম। ওখানে রবিঠাকুরের সেই বাড়িটা দেখে প্রাণ ভরে গেছিলো। ওঁর পাল্কিবাহকের বংশের একজন পুরোবাড়িটা ঘুরেঘুরে আমাদের দেখালো। স্মৃতিবিজড়িত পেন, তুলি, রংদানি, চেয়ার, বিছানা, বাথরুম, যে কেউ কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে, হাত পর্যন্ত দিতে বাধা নেই। কোনো কাঁচের আড়াল নেই। সেই কেয়ারটেকার নেপালি ভদ্রলোক এত শ্রদ্ধাশীল রবিঠাকুরের প্রতি এই ছোট জায়গায় বলা অসম্ভব। যেখানে শান্তিনিকেতনেও আমি এত আন্তরিকাতা পাইনি।
আমরা ওদের আর কত দুরে ঠেলবো!! আলাদা রাজ্য হলে কি আসে যায়? যদি মানুষগুলোকে চিরকাল তার বদলে পাশে পেতে পারি?