সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ৬ আগস্ট#
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা-র কর্ণধার বিমল গুরুং দিল্লিতে একটি ‘গোপন প্রস্তাব’ পাঠানোর কথা স্বীকার করেন একটি জনসভায়। সেই গোপন প্রস্তাবে পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড থেকে সরে এসে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। যার দরুন-ই অধুনা চালু হওয়া ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিসট্রেশন’ (সংক্ষেপে জিটিএ)। যদিও এই সময়ের মধ্যেই মদন তামাং বিমল গুরুং-দের হাত থেকে গোর্খাল্যান্ড আলাদা রাজ্যের দাবিটি ছিনিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক আসরে হাজির হতে চেয়েছিল, এবং তাতে সাড়াও মিলেছিল। এর দরুনই খুন হতে হয়েছিল মদন তামাং-কে, দার্জিলিং-এর কেন্দ্রস্থল ম্যাল-এ দিনদুপুরে। বিমল গুরুং-ও ডিগবাজি খেয়ে ফের গোর্খাল্যান্ডের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ওই চারমাসের দিনপঞ্জী বেরিয়েছিল সংবাদমন্থনের পাতায়, ২০১০ সালের ১ জুন তারিখে। এর কিছু অংশ নিচে দেওয়া হল :
২৮ জানুয়ারি ২০১০
কালিম্পঙের অন্তর্গত ঝলুং-এ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা প্রধান বিমল গুরুং বলেন, তাঁরা একটা ‘গোপন প্রস্তাব’ পাঠিয়েছেন দিল্লিতে, যাতে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি আরও কিছুটা ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়। তিনি আরও বলেন, দিল্লিকে তিনি ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি সময় দিয়েছেন, এই ‘গোপন প্রস্তাব’ বিবেচনার জন্য। মোর্চার মুখপাত্র হরকা বাহাদুর ছেত্রী পিটিআইকে জানান, ২৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমকে পাঠানো এই প্রস্তাবে ভৌগোলিকভাবে পাহাড় এবং পাদদেশের ‘গোর্খা অধ্যুষিত’ অঞ্চলকেই রাখা হয়েছে, আগের মতো পাহাড়, পাদদেশ (তরাই), শিলিগুড়ি, এবং ডুয়ার্স সহ জলপাইগুড়ি জেলার অর্ধেককে নিয়ে যে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি তোলা হয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই সরে আসা হয়েছে, কারণ ডুয়ার্সের আদিবাসীরা গোর্খাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হতে চায় না। নয়া ব্যবস্থাটিতে নামেরও বদল হয়েছে কারণ পাহাড় এবং তরাইয়ের আদিবাসী, ভুটিয়া, লেপচাদের ‘গোর্খাল্যান্ড’ নামটিতে আপত্তি আছে। গুরুং বলেন, ‘আমি এই প্রস্তাব জনসমক্ষে আনব পঞ্চম ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আগে।’ উল্লেখ্য, গোর্খাল্যান্ডের দাবির বিবেচনার জন্য কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা— এই তিনপক্ষের চারটি বৈঠক এর আগে হয়েছিল, চতুর্থটা হয়েছিল ২১ ডিসেম্বর ২০০৯, দার্জিলিঙে। গুরুং অস্বীকার করলেও এই প্রস্তাবকে মোর্চার অনেক নেতা ‘এখনই পৃথক রাজ্য’র দাবির বদলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
দার্জিলিঙের পাহাড়ে এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হয়। দার্জিলিং টাইমস পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণে এর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে জনৈক অনিল থাপা লেখেন, ‘আমি দার্জিলিং জেলার সাই যুবকদের প্রতিনিধি। আমি জিএনএলএফ সমর্থক নই, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সমর্থকও নই। একজন গোর্খা হিসেবে আমার কর্তব্য, যে ক্ষমতাবান হয়ে গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাকে সমর্থন করা। … আমি মুক্ত হৃদয়ে গোর্খাল্যান্ডে বসবাস করতে চাই।… বিমল গুরুং এখনও আমাদের নেতা। … যদি সে ব্যর্থ হয়, আমরা আরেকজনকে খুঁজে নেব।’
একবছর পর ২০১১ সালের জুলাই মাসে ‘পাহাড় চুক্তি’ মোতাবেক রাজ্য সরকার এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা একটি সমঝোতায় আসে, এতে জিটিএ-কে মান্যতা দেয় উভয়পক্ষই। কলকাতার কাগজগুলোতে খবর হয়, পাহাড় জয় করলেন মমতা। যদিও পাহাড়ের মানুষ জিটিএ নিয়ে মোটেই উচ্ছসিত ছিল না। সংবাদমন্থনের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পাহাড় ঘুরে এসে রিপোর্ট করে, পাহাড়ের মানুষ জিটিএ নিয়ে উদাসীন। গোর্খাল্যান্ড রাজ্যই তাদের মনের কথা। এর কিছু অংশ :
… কথায় কথায় কথা উঠল জিটিএ নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা খুশি? মাথা নাড়লেন এক খদ্দের। আরেক খদ্দের বুঝিয়ে দিলেন, এটা তো একটা ডিস্ট্রিক্ট নিয়ে। আমরা তো আশেপাশের তরাই ডুয়ার্সের আদিবাসীদেরও সঙ্গে চাই। আরেকজন, ভর দুপুরবেলাতেই একটু মদ খেয়েছেন। বললেন, আদিবাসীরা তো আমাদের সাথে আসতেই চায়। কিন্তু ওদের শেয়ার দেওয়া হচ্ছে না। আরেকজন সটান জানিয়ে দিলেন, আমরা গোর্খাল্যান্ড স্টেট চাই। প্রশ্ন করব কি, জেরার মুখে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে উঠে আসছি, একজন হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে বললেন, আপলোগ তো বাঙালি হ্যায় না। হামলোগকো দোস্তি রহেঙ্গে, হাঁ। ওপরে উঠে আসার সময় নজরে এল, ভুটিয়া বস্তির তিব্বতি গুম্ফার কাছেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার অফিস তালাবন্ধ।
…… পাহাড়ে যেটুকু দেখতে পেলাম, তাতে জিটিএ নিয়ে মানুষের খুব উৎসাহ আছে, তা চোখে পড়ল না। সবাই যে যার নিজের রুটি রুজি নিয়ে ব্যস্ত। জিটিএ বাস্তবে ঘিসিংয়ের সাথে চুক্তিরই আরেকটা রূপ। পরিমাণে একটু বড়ো, এই যা। আরও বেশ কিছু ডিপার্টমেন্টে লোক নিয়োগের অধিকার, আরও বেশি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি অনুদান …। খুব বেশি হলে এটাকে একটা অর্থনৈতিক প্যাকেজের বেশি কিছু বলা যায় না। পাহাড়ের লোকের তা নিয়ে খুব উৎসাহও নেই। শিলিগুড়ি থেকে ওঠার সময়ই দেখেছিলাম, সমতলের বাঙালিদেরও খুব উৎসাহ নেই এ নিয়ে। তিনদিন ব্যাপী সমতলের বনধও দ্বিতীয় ও তৃতীয়দিন নিজে থেকেই উঠে গেছে — সেরকমই শুনেছিলাম।
কলকাতায় এই চুক্তি নিয়ে মিডিয়ার বাড়িয়ে বলা এবং তার কল্যাণে মধ্যবিত্ত বাঙালি মননে প্রতিক্রিয়ার কোনো ছায়া কিন্তু দার্জিলিং পাহাড় এবং তার লাগোয়া শিলিগুড়ি সমতলে খুব নজরে আসেনি। আরেকবার মিডিয়া-রাজনীতির সত্য-বিকৃতির চেহারাটা বোঝা গেল এই ঝটিকা সফরে দার্জিলিং এসে।
Leave a Reply