নদী-সংযোগ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
- এই বছরের (২০১৫) ১৩ এপ্রিল নতুন করে একটি ‘নদী-সংযোগের জন্য টাস্ক ফোর্স’ তৈরি করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে আছেন বি এন নাভালাওয়ালা, যিনি গুজরাট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর জল বিষয়ক পরামর্শদাতা ছিলেন।
- আগে একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছিল কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারের আমলে, ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তার মাথায় ছিলেন সুরেশ প্রভু, বর্তমানে যিনি রেলমন্ত্রী। সেই টাস্ক ফোর্স ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে রিপোর্ট দেয় এবং ওই বছরই তার মেয়াদ শেষ হয়। ওই রিপোর্টে তিরিশটি নদী-সংযোগের পরিকল্পনার কথা বলা হয়।
- বর্তমান টাস্ক ফোর্সের এক সদস্য ভেদির শ্রীরাম ২০ এপ্রিল বলেছেন, ষোলোটি নদী-সংযোগের বাস্তবতা রিপোর্ট রেডি, বিস্তারিত প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে ছ’টি নদী-সংযোগের জন্য, তিনটি নদী সংযোগের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই তিনটি নদী সংযোগ হলো — কেন-বেতোয়া, দমনগঙ্গা-পিঞ্জল, এবং পার-তাপী-নর্মদা।
- নদী-সংযোগের প্রকল্পটি ২০০৪ সালের পর ধামাচাপা ছিল। তাতে নতুন করে ইন্ধন দেয় ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমারের দেওয়া একটি রায়। একটি ‘আবেদনকারী বিহীন’ রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেওয়া হয়। আগ বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই সক্রিয়তা নিয়ে সেই সময়ই প্রশ্ন ওঠে, দেশের নীতিগত বিষয়ে এক্তিয়ারের বাইরে বেরিয়ে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করছে কিনা, তা নিয়ে।
মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর প্রফেসর জনকরাজন-এর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ এপ্রিল রেডিফ ডট কম-এ। তার বাংলা অনুবাদ করেছেন শমীক সরকা#
নদী-জোড়া দেওয়ার পরিকল্পনা নতুন নয়। ১৮৫৭ সাল থেকে এসব কথা চলছে। আগে আরো দুটো প্রস্তাব ছিল, স্বাধীন ভারতে — ‘ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড’ প্রকল্প, ড. কে এল রাও-এর নেতৃত্বে করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আর একটা ‘গারল্যান্ড ক্যানাল’ প্রকল্প, ১৯৭৭ সালে ক্যাপ্টেন দস্তুরের করা।
প্রত্যেকবারই এগুলোর মৃত্যু ঘটেছে অনেক কারণে।
যখনই লোকে খুব বড়ো বড়ো প্লাবন দেখে, যেমন উত্তরাখণ্ডের বা কাশ্মীরের — লোকে নদী-জোড়ার পরিকল্পনা নিয়ে, বন্যার জল খরাপ্রবণ এলাকার দিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে।
ইদানিংকালে, ২০০৩ সালে এবং ২০১২ সালে এই ভাবনাগুলো আবার এসেছে — গোটাটাই বিচারব্যবস্থার অস্বাভাবিক হস্তক্ষেপের ফল, একে কেউ বলতে পারে বিচারব্যবস্থার আন্দোলন।
নদী-জোড়ার ভাবনাটা ওই সময় খুব জোর পেয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম এতে আগ্রহ দেখানোর ফলে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভারতে পর্যাপ্ত জল থাকবে, কেউ তৃষ্ণার্ত থাকবে না। কৃষির বৃদ্ধি এবং খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। আমি বলব, এটা ছিল তার দেশের প্রতি দরদের ফল। আদর্শবাদী দরদ!
প্রকৃতিবিরোধী
যাই হোক, বাস্তবে, এটা কিন্তু এত সহজ-সরল বিষয় নয়। আপনি কেবল মাটি খুঁড়ে জল যাবার রাস্তা তৈরি করে দিলেন, নদীর মতো বা খালের মতো বা বড়ো পাইপের মতো, যাতে উদ্বৃত্ত জল চলে যায় জল-হীন এলাকায় — বিষয়টা এত সহজ সরল নয়।
এই ধরনের সরানো-জলকে যেতে হবে বিচিত্র জায়গা দিয়ে, চড়াই উৎরাই ভেঙে, এঁকে বেঁকে, পাহাড় ডিঙিয়ে।
যার মানে দাঁড়ায়, এই ধরনের প্রকল্প বর্তমান ইকোলজি এবং পরিবেশের বিরুদ্ধে যায় এবং মোট কথা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়।
এই মেগা-প্রকল্পটিতে ৩৭টি নদীকে ৩০টি সংযোগ দিয়ে জোড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই তিরিশটি সংযোগকে পেরোতে হবে ৯,৬০০ কিমি। ৪,৫০০ কিমি লম্বা টানেল দিয়ে পাঠাতে হবে ১৭,৩০০ কোটি ঘন মিটার জল। হিসেবে করা হয়েছে, এতে তিন কোটি চল্লিশ লক্ষ হেক্টর জমি সেচসেবিত হওয়ার সম্ভবনা। এই প্রকল্পের ফলে পাঁচটি মেট্রো এবং একশো একটি জেলায় খাবারের জল পৌঁছনো সম্ভব। চৌত্রিশ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ পাওয়ার কথা।
এবার প্রকল্পটির বাস্তবতার দিকে নজর দেওয়া যাক। দক্ষিণ ভারতের নদীগুলোর কথাই ধরুন। সেখানে ১৬টি সংযোগের কথা বলা হয়েছে, ২৭টি বড়ো জলাধার সহ, এবং মোট ক্যানেল হবে ৪,৭৭৭ কিমি। ৯৪ কিমি টানেল দিয়ে সরানো হবে চৌদ্দ লক্ষ বারো হাজার আটশ’ আশি লক্ষ ঘন মিটার জল। শুধু দক্ষিণ ভারতের নদীগুলোকে জুড়তেই খরচ ধরা হয়েছে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সাতশ’ পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকা, তাও এটা ২০০৩ সালের হিসেব। এখন নিশ্চয়ই খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে।
উদ্বৃত্ত-জলের নদী
উদ্বৃত্ত নদী হিসেবে কোনগুলোকে দেখানো হয়েছে? মহানদী, কিম, তাপ্তি, তাপি, দমন গঙ্গা, পম্পা, আচানকয়েল, নেত্রবতী এবং বেতি। আরে ওড়িশার বত্রিশটা জেলার মধ্যে তেরোটা খরাপ্রবণ। কেন সেখানকার লোক মহানদীর জল সরাতে দেবে? তাদের কৃষির জন্য, শিল্পায়নের জন্য, নগরীকরণের জন্য জলের প্রয়োজন তো বাড়ছে। তার ওপর, কী দিয়ে মাপা হচ্ছে, কোন নদীর জল উদ্বৃত্ত, কোন নদীর জল নয়? কে এই প্রকল্পের উদ্গাতা? যোজনা কমিশন? নাগরিক সমাজ? রাজনৈতিক দল? কোনো রাজ্য সরকার বা ভারত সরকার? না, দুর্ভাগ্যবশতঃ এই নদী-জোড়ার নির্দেশ এসেছে সুপ্রিম কোর্টের তরফে।
এটাই আশ্চর্যের যে এইরকম একটা মেগা-প্রকল্প, যার বহু দিক রয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসেনি। এসেছে বিচারব্যবস্থার হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে, যার মধ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক, ফিনান্সিয়াল, ইকোলজিক্যাল এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কোনো হিসেবেনিকেশ নেই। এটা যদি আসতেও হয়, তাহলে বিধানসভা এবং লোকসভা রাজ্যসভায় বিতর্কের মধ্যে দিয়ে আসা দরকার।
মেগা-খরচ
এই মেগা-প্রকল্পের খরচ ২০০৩ সালে হিসেবে করা হয়েছিল ৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা। এখন নিশ্চয়ই তা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, অবাক লাগে, এই প্রকল্পের যে খরচ ধরা হয়েছে, তা কিসের ভিত্তিতে ধরা হয়েছে? এই খরচের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। যদি তাও ধরে নেওয়া হয়, এই খরচ বাস্তবসম্মত, তাহলে এখন তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬ লক্ষ কোটি টাকায়।
এই প্রকল্প এখনো শুরু হয়নি, কেউ জানে না, কবে শুরু হবে। আর তখন এর খরচ কত দাঁড়াবে?
চীন, রাশিয়া যে দেশেই এই ধরনের প্রকল্প করা হয়েছে, তা জাতীয় বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইকোলজির কাছে। প্রতিটি নদীতে থাকে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। অসংখ্য জীবন। নদীর ওপর নির্ভর করে এলাকার ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরের পরিমাণ। সমস্ত কিছু ব্যাহত হয়েছে।
খুব ছোটো ধরনের নদী-জোড়ার প্রকল্প করা যায়। যেমন, তামিলনাড়ুতে পশ্চিমমুখী নদীগুলির জল সরিয়ে পূর্বদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরম্বিকুলাম-আইয়ার প্রকল্পে। তাতে কোয়েম্বাটোর জেলার লক্ষ লক্ষ একর কৃষিজমিতে জলসেচ সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের ছোটো সংযোগ হয়ত সম্ভব, কিন্তু তাতেও ইকোলজির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ে। তার ওপর বড়ো প্রকল্পের জন্য লক্ষ লক্ষ একর জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন। প্রায় ৮,০০০ বর্গ কিমি জমি প্রয়োজন। কত বছর লাগবে এত জমি অধিগ্রহণ করতে?
মেগা-উচ্ছেদ
তাছাড়া, সরকার তো এরই মধ্যে বহু একর জমি অধিগ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। তাতে পুনর্বাসনের এবং ক্ষতিপূরণের কী অবস্থা? আমাদের দেশে এখনো বিভিন্ন জমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া তিরিশ লক্ষ লোক পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে। যখন আমরা এই ধরনের বড়ো প্রকল্পের ব্যাপারে কথা বলি, তখন কি আরো বহু লক্ষ উচ্ছেদ হতে বসা লোকের পুনর্বাসনের কথা ভাবি?
তাছাড়া এত বড়ো প্রকল্পের একটা সুরক্ষা ও পরিচালনার খরচ রয়েছে। তাতে প্রকল্পের খরচের অন্তত দশ শতাংশ খরচ হবেই, অর্থাৎ ২ লক্ষ কোটি টাকা প্রায়। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এত টাকা আমাদের রয়েছে? নাকি আমরা সুরক্ষা ও পরিচালনার গোটা ব্যাপারটাকেই বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেব বলে ভাবছি। তার মানে দাঁড়ায় আমাদের সমস্ত নদীগুলোকে বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। তাছাড়া, প্রচুর সশস্ত্র বাহিনী লাগবে এত এত জলাধার, ক্যানেল, এবং অন্যান্য কিছু পাহারা দেওয়ার জন্য। এত কিছুর বন্দোবস্তের কথা কি ভাবা হয়েছে?
নদীর জল রাজ্যের
এছাড়াও আর একটা কথা রয়েছে। জল রাজ্যের অধিকারে। আরে নদী কি জাতীয়করণ করা যায়? তাহলে তো আপনাকে সংবিধানে বিস্তর সংযোজনী দিতে হবে। রাজনৈতিকভাবে এ কাজ খুবই কঠিন। নদীর জল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে এখনই অনেক লাঠালাঠি আছে। কাবেরী নদীর জল নিয়ে কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর মধ্যের বিরোধের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আর এই জাতীয় নদী-সংযোগ প্রকল্পে অন্তত ষোলোটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে একমত হতে হবে।
আমাদের দেশ বিচিত্র ভাষা ও সংস্কৃতির রাজ্য নিয়ে তৈরি। সমস্ত রাজ্যেরই তাদের নদীগুলির জল সংরক্ষণে স্বার্থ রয়েছে। সংবিধানেও তার স্বীকৃতি রয়েছে। জাতীয় নদী-সংযোগ প্রকল্প কখনোই বাস্তবায়িত হতে পারবে না, যদি দাতা রাজ্য একমত না হয়। এই দাতা-রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি, কেরালা ইত্যাদি। আর গ্রহীতা-রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু। তারা হয়ত এই প্রকল্পকে সাদর অভ্যর্থনা করবে।
আর এই প্রকল্পের সামাজিক ফলাফল কেউ ভেবে দেখেছে? আট হাজার বর্গ কিমি জমি যদি নিতে হয়, কতগুলো গ্রাম ডুববে? কয়েল লক্ষ আদিবাসী মানুষ উচ্ছেদ হতে চলেছে, এবং তাদের পুনর্বাসনের কোনো বন্দোবস্ত নেই। আপনি কেবল তাদের জমি দিয়ে কাজ সারতে পারেন না। কারণ সেই জমি তাদের জীবনধারনের কাজে সহায়ক হবে না।
নদী-সংযোগ করে বন্যা রোধ করা যায় না
প্রতিবেশী দেশগুলি, যেমন, নেপাল ভূটান এবং বাংলাদেশেরও এই প্রকল্পে আপত্তি রয়েছে। আমরা বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছি, ব্রহ্মপুত্রের কিছু জল তাদের দেওয়া হবে। নদীর জল সরিয়ে নিলে নদীর প্রবাহ কী করে থাকবে সেখানে? শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলিও খুব চিন্তিত।
আরেকটি বিষয়ও ভাবার মতো। এই বড়ো বড়ো নদীগুলো কেবল বর্ষার মরশুমেই বেশি জল বহন করে। আর বর্ষাকালেই অন্যান্য জায়গাতেও বন্যা সম্ভাবনা তৈরি হয়। খরার মাসগুলোতে ওই তথাকথিত উদ্বৃত্ত নদীগুলি দিয়ে বেশি জল যায় না। তাই যখন প্রয়োজন হবে, তখন উদ্বৃত্ত জল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া, খুব বেশি হলে বন্যার জলের সর্বাধিক দশ শতাংশ সরানো যায় ক্যানেল করে। বাকি নব্বই শতাংশ বন্যার জল থাকবে। তাই নদী-জোড়া দিয়ে বন্যা আটকানো যাবে — এই কল্পকথার বাস্তব ভিত্তি নেই।
আমার মনে হয় এই প্রকল্প কাগজে কলমেই রয়ে যাবে। যদি এই প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তা দেশের পক্ষে, ইকোলজির পক্ষে, পরিবেশের পক্ষে সর্বনাশা বিপদ ডেকে আনবে।
Kirity Roy says
ধন্যবাদ, একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ।