তাহেদুল ইসলাম, মোমিনপুর, জলপাইগুড়ি, ৩১ জুলাই ##
সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে আমরা চারজনের একটি প্রতিনিধিদল আজ ৩১ জুলাই জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ার দুই নম্বর ব্লকের মোমিনপুর আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করলাম। এই আশ্রয়শিবির গড়ে উঠেছে মোমিনপুর মসজিদ এবং আকবর শিশু বিকাশ অ্যাকাডেমিতে, মোট এক হাজার উনসত্তর জন লোক এখানে বসবাস করছে। এরা সবাই আসামের কোকড়াঝাড় জেলার লোক। এর মধ্যে রয়েছে শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা যুবক যুবতী সবাই। আমরা যখন দুপুর বারোটার সময় ওখানে পৌঁছলাম, দেখলাম পঁয়ষট্টি বছরের একজন বৃদ্ধ, তিনি আমাদের জানালেন, তিনি সকালবেলায় চা আর একটা বিস্কুট খেয়েছেন। এখন পর্যন্ত আর কিছু খাবার পাননি। আর একজন শতবর্ষ পার হওয়া বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমি রোজা রেখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি খেয়ে রোজা রেখেছেন? উনি বললেন, একখানা বিস্কুট আর পানি খেয়ে রোজা রেখেছি। আশ্রয়শিবিরে উপস্থিত ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ বলল, সকাল থেকে কিছু খায়নি, কেউ বলল, চা বিস্কুট খেয়েছে।
আমরা ওখানে থাকাকালীনই শুনলাম, কংগ্রেসের বিধায়ক মৌসম বেনজির নূর আসবেন। এখানে সেই উপলক্ষে অনেক নেতা এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত উনি এলেন না। দুটোর সময় খাবার দেওয়া শুরু হতেই বিরাট লাইন পরে গেল। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর পাতে খাবার পড়ল। চেয়ে দেখলাম, ভাত আর ডাল। কারও কারও পাতে সয়াবিন। আমরা জিজ্ঞেস করতে সবাই বলল, আমরা সাতদিন ধরে এই খাবারই খাচ্ছি শুধু। কখনও কখনও টিফিন পাওয়া যাচ্ছে। দুপুর দুটো নাগাদ ভাত, কোনওদিন ডাল থাকছে, কোনওদিন তরকারি থাকছে।
আশ্রয়শিবিরের লোকজন জানাল, সরকারের তরফে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও আশ্রয়শিবিরের হাল বেশ খারাপ। রাজনৈতিক দলের নেতারা আসছেন যাচ্ছেন, কিন্তু তারা মূলত লোক দেখাতেই ব্যস্ত। আমাদের জন্য কিছু করছেন না। এই মুহুর্তে এক হাজারের ওপরে মানুষ, মাত্র তিনখানা ঘরে বসবাস করছি। পুরুষরা বেশিরভাগই রাত্রে গাছতলায় থাকছে। আরও অন্তত দু-তিনটে ঘর না হলে সমস্যা। আর আমাদের খাবারের ভীষণ প্রয়োজন। কিছু মানুষ আমরা রোজা রাখতে চাইছি, কিন্তু ভোর রাতে বা সন্ধ্যের সময় খাবার পাচ্ছি না। আর আমাদের পোশাকেরও দরকার। আমরা এক কাপড়ে এসেছি। কোনও পোশাক নিয়ে আসতে পারিনি।
আপনারা কি আপনাদের ঘরে ফিরে যেতে চাইছেন? — এ প্রশ্নের জবাবে তারা জানালেন, আমরা ফিরে যেতে চাই, কিন্তু ফিরে যাওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি দেখছি না। আমরা খুব ভয়ে আছি।
আমরা মনে করছি, ফিরে গেলে আবার আক্রমণ করা হবে। এবার গেলে হয়ত আমাদের প্রাণে মেরে ফেলা হবে। তাই আমরা ফিরতে চাইছি না।
এই রাজ্যের সরকার যদি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে, তাহলে আপনারা কি থাকবেন এখানে? — প্রশ্নের উত্তরে তারা জানাল, সে ব্যাপারে তারা একা কিছু বলতে পারবে না। সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে তবে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব।
প্রতিনিধিদলের অভিজ্ঞতা, আসাম সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেউই এই শরণার্থীদের যেভাবে যত্ন নেওয়ার কথা, সেভাবে যত্ন নিচ্ছে না। ছোট্ট একটা মসজিদে হাজারের ওপরে মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করছে। অবিলম্বে যদি তাদের যত্ন না নেওয়া হয়, তাহলে যে কোনো ছোঁয়াচে অসুখ বা ডাইরিয়া ছড়াতে পারে।
আপনাদেরকে মারছে কারা, আর মরছে কারা? — এ প্রশ্নের উত্তরে শরণার্থীরা জানাল, ওখানে যারা বোড়ো, তারা বাদ দিয়ে আর সবাইকে মারছে। বোড়োদের বক্তব্য, এখানে বোড়োল্যান্ডে যারা অ-বোড়ো, সে মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, বা আর কিছু হোক — কাউকে ওরা থাকতে দিতে চাইছে না।
একজন বিএ পাশ যুবক শরণার্থী জানালেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে সাঁওতালদের তাড়ানো হয়েছিল। সেই সময় সাঁওতালরা এইসব এলাকাতেই আশ্রয় নিয়েছিল। এই আশ্রয়শিবিরে যারা এসেছে, তারা যে গ্রাম থেকে এসেছে সেগুলি সম্পূর্ণ মুসলিম গ্রাম। তাই এই আশ্রয়শিবিরে কেবল মুসলিমরাই আছে। বোড়োদের আক্রমণের শিকার সবাই — মুসলিম, হিন্দু, সাঁওতাল সবাই। একটা একটা করে টার্গেট করছে। ছিয়ানব্বই সালে সাঁওতালদের মেরেছে। তারপর অমুসলিম বাঙালিদের তাড়িয়েছে। তারপর অসমিয় হিন্দুদের তাড়িয়েছে। এরপর টার্গেট মুসলমানরা।
Leave a Reply